চট্টগ্রামের বইমেলা। সিআরবি
চট্টগ্রামের বইমেলা। সিআরবি

চট্টগ্রামের বইমেলার কি একটা স্থায়ী ঠিকানা হবে না

শতাব্দীপ্রাচীন বৃক্ষরাজিকে নির্বিঘ্নে বাঁচিয়ে রাখতে, পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে যেখানে হাসপাতাল নির্মাণে বাধা দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ, সেই সিআরবিতে এখন বইমেলা চলছে। এই বইমেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। আর তাতে সহযোগিতা করছে চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ। নতুন স্থানে প্রাকৃতিক পরিবেশে শিরীষগাছের তলায় নাগরিক কোলাহলের অনতিদূরে বইমেলা জমবে কি না, অনেকের সন্দেহ ছিল। সেই কারণে তাঁরা ওখানে বইমেলা করার বিপক্ষে ছিলেন।

পরিবেশবাদীরাও এখানে মেলার বিপক্ষে ছিলেন। অল্প কয়েক দিনের জন্য হলেও মেলার জনসমাগম এখানকার সবুজ পরিবেশের ক্ষতি করবে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বইমেলার বিকল্প স্থান আর পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অনুমতি নিয়ে তাদের জায়গা ওই সিআরবিতেই বইমেলা করতে হলো।

স্বাধীনতার পর অর্ধশতকেরও বেশি বছর পার হয়ে গেল, চট্টগ্রামে বইমেলার জন্য একটি স্থায়ী জায়গা পাওয়া গেল না। এই দুঃখ এখানকার বইপ্রেমী, সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, প্রকাশকদের বড় পীড়া দেয়। বিশেষ করে ভাষার মাস কাছে এলে এই বঞ্চনার কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হতো।

১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। কিন্তু চট্টগ্রামের প্রথম বইমেলাটি হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাঠে। অবশ্য সেটা অব্যাহত থাকেনি। পরের বছরগুলোয় তরুণ কবিরা চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে টেবিল নিয়ে তাঁদের ছোট কাগজের পসরা সাজাতেন। মানুষ আগ্রহ ভরে এক পয়সা-দুই পয়সায় লিটল ম্যাগাজিনগুলো কিনতেন। ২১ ফেব্রুয়ারির দিনে শহীদ মিনারে টেবিলে বই বিক্রি চলেছে দীর্ঘদিন।

প্রায় পুরো আশির দশক, স্বৈরাচারের আমলে বইমেলার কোনো আয়োজন দেখা যায়নি। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউটের মাঠে ১৯৯০ সালে বইমেলা শুরু করে চট্টল ইয়ুথ কয়ার নামের একটি সংগঠন। প্রথম বছর এলোমেলোভাবে হলেও পরবর্তী সময় চট্টল ইয়ুথ কয়ারের এই উদ্যোগকে সহায়তা করেন সাংবাদিক, কবি, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। তখন চট্টগ্রামে দু-একটি প্রকাশনা সংস্থা ছিল। বেশির ভাগ বই লেখকের উদ্যোগেই প্রকাশ পেত।

চট্টল ইয়ুথ কয়ারের বইমেলায় প্রকাশকের অংশগ্রহণ ছিল কম, বই বিক্রেতারাই স্টল খুলে বসতেন। শুধু বইমেলা নয়, কবিতা, ছড়া উৎসব ছাড়াও এ সময় নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকত এসবে। টানা ১২ বছর ইয়ুথ কয়ারের বইমেলা চলেছে। সেটি কখনো ঢাকার বইমেলার মতো চরিত্র পায়নি। পেশাদারত্ব ছিল না।

পরবর্তী সময় গত শতকের শেষের দিকে মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকাকালে উদ্যোগ নেন বইমেলার। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি লালদীঘির মাঠে বইমেলার আয়োজন করেন। সেই সময় সিটি করপোরেশন লালদীঘির পাড়ে, ইয়ুথ কয়ার মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে একসঙ্গে দুটি মেলা হয়। একপর্যায়ে এমনও দেখা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে একসঙ্গে তিনটি বইমেলা চলছে। ডিসি হিলে, লালদীঘিতে আর মুসলিম হলের মাঠে। কিন্তু কোথাও বই নেই, প্রকাশক নেই, পাঠক নেই—একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

২০০৮ সালে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ মুসলিম হলের সামনে আবার বইমেলা শুরু করে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন লালদীঘির মাঠে তাদের মেলাটি চালু রেখেছে। এ রকম দুটি অসম্পূর্ণ মেলায় বইয়ের পাঠক, লেখক আর প্রকাশকের কোনো উদ্দেশ্য সফল হতো না। এ রকম পরিস্থিতি চলেছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। অবশেষে ২০১৯-এ তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের হস্তক্ষেপে সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি, কবি-লেখকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একক এবং অভিন্ন আয়োজনে চট্টগ্রামের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম মাঠে। শতাধিক নামী প্রকাশনা এ বইমেলায় অংশ নেয়। ঢাকা থেকেও দেশখ্যাত ৩৮টি প্রকাশনা তাতে যোগ দেয়।

করোনার সময় ছাড়া এই মাঠে মেলা চলছিল নির্বিঘ্নে। এ বছর থেকে আবার শুরু হলো স্থান-সংকট। শেষ পর্যন্ত মেলা গড়াল সিআরবির শিরীষতলায়। ৪৩ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে সিআরবি শিরীষতলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৯২টি প্রকাশনা সংস্থার ১৫৫টি স্টল নিয়ে মেলা চলছে।

চট্টগ্রামের প্রকাশনার একটা গৌরবময় ইতিহাস আছে। দ্য আর্ট প্রেসভিত্তিক বইঘর আর সিগনেট প্রেসভিত্তিক দোলনা প্রকাশনীর মতো উন্নত মানের প্রকাশনা ছিল এখানে। মোহাম্মদ শফির আর্ট প্রেস থেকে শুধু চট্টগ্রামের নয়, ঢাকার এমনকি কলকাতার অনেক নামীদামি কবি-লেখকের বই বেরিয়েছে। বের হতো ‘টাপুর টুপুর’ নামের অত্যন্ত মানসম্পন্ন আর জনপ্রিয় কিশোর সাময়িকী। সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত তরুণ কবি-লেখকেরা নানা প্রতিবাদী ও ব্যতিক্রমী ছোট কাগজ নিয়ে মেলায় হাজির থেকেছেন। মাঝখানে একটা স্থবির সময় কেটেছে। বইঘর তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিল। দোকান গুটিয়ে নিল। চট্টগ্রামের বিখ্যাত কারেন্ট বুক সেন্টার নানা জায়গায় স্থানান্তরিত হলো, দোলনা প্রকাশনা বন্ধ হলো, বইয়ের দোকানগুলোর অস্তিত্ব থাকল না।

তবে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে চট্টগ্রামের পাঠক-লেখকেরা। একটা অন্ধকার সময় পেরিয়ে আবার নতুন যুগ শুরু হলো চট্টগ্রামের বইয়ের জগতের। এখন চট্টগ্রামে ৫০টির বেশি প্রকাশনা সংস্থা আছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে সিটি করপোরেশন বইমেলা করছে প্রতিবছর। মুসলিম হল প্রাঙ্গণ, লালদীঘির মাঠ, এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম মাঠ ইত্যাদি ঘুরে এসে বইমেলার এবার ঠাঁই হয়েছে বন্দরনগরীর ‘ফুসফুস’ নামে খ্যাত সিআরবির শিরীষতলায়। প্রতিদিন মেলায় আসে হাজারো মানুষ।

বইমেলার ঢোকার আগে বিভিন্ন খাবার ও রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভ্রাম্যমাণ দোকানিরা। প্রচণ্ড ভিড়ে মেলায় প্রবেশ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। কষ্ট করে মেলায় ঢুকেই মানুষ বুঝতে পারে তারা আসলে ধুলাবালুর রাজ্যে প্রবেশ করেছে। মেলায় আরেকটি পীড়াদায়ক ব্যাপার হলো, সর্বক্ষণ গগনবিদারী মাইকের আওয়াজ। যে-কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই বলেন, মাইকের আওয়াজে টেকা দায়। মেলা যতক্ষণ চলে ততক্ষণ আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মান নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন। ভ্যারাইটি শোয়ের মতো এমন হইচই আর ধুমধাড়াক্কা গান-নাচের আসর বইমেলার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তা-ও অনেকে প্রশ্ন তোলেন।

এই মেলা চলবে আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত। যে কয়দিন বাকি আছে, অন্তত সে কয়দিন শব্দদূষণ না করলে কিছু মানুষ শান্তিতে মেলায় বই দেখবেন এবং কিনবেন। দু-একটি এমন অভিযোগ ছাড়া সিআরবির শিরীষতলায় শ্যামল-সবুজ পরিবেশে মেলার আয়োজনে চট্টগ্রামবাসী খুশি। তবে এখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি থেকেই যায়। ফলে বইমেলা নিয়ে মানুষের মনে আশঙ্কা রয়ে যায়। লালদীঘির পাড়, মুসলিম হলের মাঠ, ডিসি পাহাড়, জিমনেসিয়ামের মাঠ ঘুরে সিআরবি শিরীষতলা। এরপর? আগামী বছর কোথায় হবে? একটা স্থায়ী বইমেলার জায়গার অধিকার কী চট্টগ্রামবাসীর নেই? সেই অধিকার নিয়ে সিটি করপোরেশন কী ভাববে? নাকি এবারের মতো ফেব্রুয়ারি কাছে এলেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করবে?

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক ও কবি