স্বীকৃতি না পেয়ে তালেবান কি হতাশ

আফগানিস্তানে নারীশিক্ষার অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা
ছবি: সংগৃহীত

আফগানিস্তানের শাসকেরা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য খাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি করতে সক্ষম হলেও তারা এখন পর্যন্ত কোনো দেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি।

তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে; তারপরও তাদের শীর্ষ প্রশাসন অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে নিজেদের শর্তে অবিচল থাকার ওপর জোর দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে তালেবান সরকারে হতাশা ক্রমশ বাড়ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে তালেবানের ক্রমবর্ধমান ক্রোধের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান এবং তারা খোলাখুলিভাবে পাকিস্তানের সমালোচনা করতে শুরু করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কয়েক সপ্তাহ আগে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আফগানিস্তানে বিদেশি চরমপন্থী সংগঠনের উপস্থিতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, এই চরমপন্থীরা পাকিস্তানকেও নিশানা করেছে।

মজার ব্যাপার হলো, অন্যান্য অনেক মুসলিম দেশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মতোই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যেমন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্তের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হওয়া থেকে রোধ করতে সব দেশের মধ্যে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবু তালেবান শাসকেরা প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন তালেবান কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আফগান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শের আব্বাস স্তানিকজাই সবচেয়ে আক্রমণাত্মক সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, স্রেফ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পাকিস্তান আফগানিস্তানের নামে এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছে।

স্তানিকজাইয়ের বক্তব্যের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশটি ছিল, তালেবানের কাছে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের কারসাজিমূলক ভূমিকার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হই তাহলে কেউ আমাদের থামাতে পারবে না’। এটিকে পাকিস্তানের প্রতি একটি হুমকি হিসেবে ব্যাখ্যা করে বলা যেতে পারে, সময় হলেই পাকিস্তানকে পাল্টা জবাব দেওয়ার চিন্তা তাদের মধ্যে রয়েছে।

তালেবান বিশ্বাস করে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অন্যায্য। কারণ, তারা তাদের দেশে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস-কের (ইসলামিক স্টেট-খোরাসান) হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারীরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের কাছে মেয়েদের শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্তানিকজাইসহ কিছু তালেবান নেতা মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়ে তালেবানের মুরব্বিস্থানীয় নেতাদের মতের সঙ্গে একমত নন। তাঁরা নারীশিক্ষার মতো কিছু ইস্যুতে উদার হওয়ার পক্ষে।

এর জন্য তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর দাবি করেছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা আইএস-কে গোষ্ঠীকে নির্মূল করবে। কিন্তু দেখা গেল, তাদের এই মতাদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীটি ধীরে ধীরে তাদের ত্বকের নিচে গেড়ে বসেছে। তালেবান দখলের পর থেকে কাবুলে ১৬টির বেশি কূটনৈতিক মিশন কাজ শুরু করেছে।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে কাবুলে ১৬টির বেশি কূটনৈতিক মিশন কাজ করছে। আইএস-কে তালেবানের এ দাবিকে ভুল প্রতিপন্ন করতে চায় যে তালেবান তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে। কাবুলে রুশ কূটনৈতিক মিশনে আইএস-কে গোষ্ঠীর হামলাকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।

অন্যদিকে, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) তালেবানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া কঠিন করে তুলছে। টিটিপির পুনরুত্থানের অর্থ হলো আল–কায়েদা এবং ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) এবং ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তানের (আইএমইউ) মতো গ্রুপগুলোও সেখানে জায়গা করে নিতে পেতে পারে, যা চীন এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্য উদ্বেগজনক।

তালেবান শাসন পাকিস্তান ছাড়াও চীন, উজবেকিস্তান, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, তুরস্ক, ইরান এবং অন্যান্য অনেক দেশের সঙ্গে কয়েকটি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহায়তা চুক্তি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

সেই সঙ্গে তাদের সম্পদকে যুক্তরাষ্ট্রের জব্দ করার হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছে। তবে তালেবান জানে, এটি একটি দেশের সার্বিক বিষয় চালানোর জন্য যথেষ্ট নয় এবং শুধু বাণিজ্য কখনোই সরকারের সঙ্গে সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বিকল্প হতে পারে না।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, আফগানিস্তান বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলার দিকে যাচ্ছে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে আফগানিস্তানকে সাহায্য করার জন্য তিনি বিশ্বকে আহ্বান জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারীরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের কাছে মেয়েদের শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্তানিকজাইসহ কিছু তালেবান নেতা মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়ে তালেবানের মুরব্বিস্থানীয় নেতাদের মতের সঙ্গে একমত নন। তাঁরা নারীশিক্ষার মতো কিছু ইস্যুতে উদার হওয়ার পক্ষে।

অর্থাৎ দেশ পরিচালনার নীতি ঠিক করার বিষয়েই তালেবান সরকারের মধ্যে মতপার্থক্য দৃশ্যমান হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতা তালেবান সরকারকে কোথায় নেবে, তা আপাতত বলা যাচ্ছে না।

পাকিস্তানের ডন পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মোহাম্মাদ আমীর রানা পাকিস্তানের প্রখ্যাত প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক