হোয়াাইট হাউসে জো বাইডেন ও ভলোদিমির জেলেনস্কি
হোয়াাইট হাউসে জো বাইডেন ও ভলোদিমির জেলেনস্কি

বাইডেনের যে ভুলে ইউক্রেন এখন গোটা বিশ্বের বিপর্যয়

শীতল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া সহজাত প্রবৃত্তির কারণে জো বাইডেন ‘সংঘাতকে প্রশমিত’ করার কৌশলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ২০২২ সালের মার্চ মাসে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের এক মাস পর, পোল্যান্ডের ওয়ারশে জো বাইডেন তাঁর বক্তৃতায় ভ্লাদিমির পুতিনের পায়ের রেখা কতদূর পর্যন্ত আসতে পারবে, তার একটা লাল রেখা এঁকে দিয়েছিলেন। বাইডেন সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘ন্যাটোর এক ইঞ্চি ভূখণ্ডে পা বাড়ানোর চিন্তা কোরো না।’

বাইডেন অঙ্গীকার করেছিলেন, পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দেবে, মস্কোর ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেবে এবং রাশিয়ার মুদ্রা রুবলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। ইউক্রেন যদিও ন্যাটোর সদস্য নয়, তবু বাইডেন এ সংঘাতকে মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন। কিন্তু ন্যাটোকে প্রথম আক্রমণ না করার আগপর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ার নীতিতে অটল থাকেন।

রাশিয়া–ইউক্রেন সংঘাতের ৩০ মাস এখন চলছে, বাইডেনের প্রশমিত করার কৌশল চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসা না করলে যেমন সারা শরীরে তা ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি ইউক্রেন সংকট এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। দনবাসের কাদা ও বরফ আচ্ছাদিত ভূখণ্ড ছড়িয়ে এই যুদ্ধ বিশ্বপরিসরে বিপর্যয় তৈরি করছে। যেখানে যেখানে এই সংঘাত স্পর্শ করছে, সেখানটাতেই দূষিত করে ফেলছে।

এটা সত্যি যে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে একটা ‘গরম’ যুদ্ধ এখন পর্যন্ত এড়ানো গেছে। কিন্তু পথচ্যুত মিসাইল ও সমুদ্রযুদ্ধের গোলা পোল্যান্ড ও রুমানিয়ায় গিয়ে পড়েছে। বেলারুশের মতো গোটা কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের দেশগুলো এখানে জড়িয়ে পড়েছে।

পুতিন দাবি করছেন, পশ্চিমারা এরই মধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন। প্রপাগান্ডা প্রচারকারীরা তো পোল্যান্ডকে হাওয়ায় মিশিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

বক্তৃতায় খুব আবেগঘনভাবে বাইডেন ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ইউক্রেন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। এই বক্তব্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রভাব ছিল—এটা স্বীকার করেই বলছি, সে সময়ে বাইডেনের উচিত ছিল রাশিয়ার স্বৈরশাসককে স্পষ্ট করে এটা বলা, ‘এটা ভুলে যাও। আগ্রাসন কোরো না। আগ্রাসন চালালে তোমাকে রাশিয়ার চেয়ে আরও অনেক শক্তিশালী জোট ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।’

এ সংকট ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র–ইউরোপের মধ্যে বিভক্তির সূত্রপাত করেছে। ইউক্রেনে সেনা পাঠানো কিংবা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। ইউক্রেনকে ন্যাটো কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত করা নিয়ে, ইউরোপের জন্য আলাদা একটা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়েও বিভক্তি তৈরি হয়েছে। ফ্রান্সের নতুন আগ্রাসী অবস্থান বাতিল হয়ে গেছে জার্মানির অতি সতর্ক অবস্থানের কারণে।

নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুইডেন ও ফিনল্যান্ড আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ন্যাটোয় যুক্ত হতে চাইছে। বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলো রাশিয়ার আগ্রাসনের ভয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত। হাঙ্গেরি ও সার্বিয়া রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করে চলছে। ইতালি নড়েচড়ে বসছে। কেউই নিরাপদ বোধ করছে না।

এই যুদ্ধ ডান ও বাম—দুই শিবিরের রাজনৈতিক চরমপন্থাকে উসকে দিচ্ছে। জনতুষ্টিবাদী নেতাদের পেছনে পুতিন প্রচুর অর্থ ঢালছেন। গত সপ্তাহে মালদোভায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়াসংক্রান্ত যে গণভোট হয়েছে, সেখানে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইয়া সান্দু। ক্রেমলিনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, বিদেশি শক্তির সহায়তায় একটি অপরাধী গোষ্ঠী এ কাজে জড়িত।

ব্রিকস সম্মেলনে মোদি, পুতিন ও সি

মস্কো এখন এ সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় জর্জিয়ার নির্বাচনের দিকে নজর রাখছে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পশ্চিমাপন্থী দলকে তারা হারিয়ে দিতে চাইছে। এ ধরনের হাইব্রিড যুদ্ধ (ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড, অপতথ্য ছড়ানো, নির্বাচনে প্রভাব তৈরি, সাইবার হামলা, জালিয়াতি, অনলাইন ট্রলিং) ২০২২ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কেননা, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা রাশিয়ার পুতিনকে গুরু মানছে।

যুদ্ধ প্রশমনের ব্যর্থতা ওলট–পালট করে দেওয়ার মতো ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনকে উৎসাহিত করছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, চীন–রাশিয়ার সম্পর্কের মধ্যে ‘কোনো সীমা’ থাকবে না। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সস্তায় তেল পাচ্ছেন। এর বিনিময়ে পুতিন বেসামরিক–সামরিক কাজে ব্যবহারের প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সমর্থন পাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপারটি এর চেয়েও আরও অনেক বেশি।

গত সপ্তাহে পুতিনের নিমন্ত্রণে ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা এবং ন্যাটো সদস্য তুরস্ক অংশ নেয়। পুতিনের কল্পনা করেন একটি পশ্চিমাবিরোধী জোটের আর সি চিন পিং স্বপ্ন দেখেন চীনের নেতৃত্বে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে নেতৃত্ব দেবে চীন।

এ স্বপ্ন এখন আর শুধু স্বপ্নের মধ্যে আটকে নেই। দ্বিতীয় সারির শক্তির অনেক দেশ ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য রাশিয়াকে নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানায়।

যুদ্ধের যে বিশাল খরচ, সেটা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক হিসাব করে জানিয়েছে, প্রথম দুই বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ১৫২ বিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের অনুমান, ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। প্রতিদিনই এই অঙ্কের পরিমাণ বাড়ছে।

এদিকে নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে এবং ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে রাশিয়া একটা ছদ্মবেশী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।

এ যুদ্ধে মানুষ জীবন হারাচ্ছে, যার মূল্যকে অর্থমূল্যে বিচার করা সম্ভব নয়।

জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ১০ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে এর দ্বিগুণ। ৩০ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হতে পারে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ১ লাখ ১৫ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৫ লাখ।

রুশ সমাজকে এ যুদ্ধে আরও নানা মূল্য দিত হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসন তীব্র হচ্ছে, দুর্নীতি প্রবল রূপ নিচ্ছে, ভিন্নমতালম্বী ও মুক্ত গণমাধ্যমকে সীমাহীনভাবে দমন করা হচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে হারেনি, এটা দেশটির জন্য অসাধারণ এক অর্জন। কিন্তু এটাকে কোনোভাবেই বিজয় বলা যায় না। নানা বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমা সহযোগিতার পরিমাণ কমে গেছে। রাশিয়ার সেনারা অগ্রসর হচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ‘বিজয়পরিকল্পনা’ গ্রহণকারীর সংখ্যা সামান্যই। এর মধ্যে শীতকাল আসন্ন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর সবকিছু কতটা ঠেকানো সম্ভব হতো? কিছু বিষয়, যেমন চীন–রাশিয়ার মৈত্রী ও ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদের উত্থান ধীরে ধীরে ঘটত। যুদ্ধ কেবল সেগুলোর গতি দ্রুত করেছে। কিন্তু অনেক বড় ক্ষতি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে এড়ানো সম্ভব ছিল।

আমরা ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ফিরে যায়। ওয়ারশে আমরা স্পষ্টবাদী ও সদম্ভ জো বাইডেনকে দেখতে পেয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা জানতেন, একটা আগ্রাসন আসন্ন। বাইডেন পুতিনকে বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এটা পুতিনের জন্য বড় একটা ভুল হবে।

সেই বক্তৃতায় খুব আবেগঘনভাবে বাইডেন ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ইউক্রেন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। এই বক্তব্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রভাব ছিল—এটা স্বীকার করেই বলছি, সে সময়ে বাইডেনের উচিত ছিল রাশিয়ার স্বৈরশাসককে স্পষ্ট করে এটা বলা, ‘এটা ভুলে যাও। আগ্রাসন কোরো না। আগ্রাসন চালালে তোমাকে রাশিয়ার চেয়ে আরও অনেক শক্তিশালী জোট ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।’

এটাকে বলে বাধা দেওয়া। ন্যাটো গঠিত হয়েছে এটা করার জন্যই।

  • সাইমন টিসডাল, অবজার্ভার–এর বিদেশবিষয়ক বিশ্লেষক
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে