বেশ কয় বছর ধরেই পত্রপত্রিকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত জায়গা পাচ্ছে। ‘জায়গা করে নিচ্ছে’ বললাম না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্যই দেশ-বিদেশের প্রচারমাধ্যমে জায়গা করে নেয় সবচেয়ে বেশি। এটাই নিয়ম।
কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি মোটেও সে রকম নয়, বরং উল্টোটাই সত্য। এখানে মোটাদাগে প্রশাসনের অনিয়মটাই নিয়ম। এ সুবাদেই প্রচারমাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানলাভ ঘটছে।
আমি ইতিহাসের ছাত্র। হয়তো সেই দোষেই বর্তমানের কোনো কিছু চোখে পড়লে মন চলে যায় অতীতে। এখানে বর্তমান ও অতীতের কোনো ভেদ আর নেই। অতীত ও বর্তমানের সংযোগ সুতার পাকে সত্য লুকিয়ে থাকে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ছয় দশক ছুঁই ছুঁই। সেই হিসাবে শুরু থেকে আজ অবধি যাঁরা উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যের উচ্চ আসন অলংকৃত করে এসেছেন, তাঁদের সংখ্যাও বেশ সমীহ জাগানোর মতো। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ভালো প্রশাসক-শিক্ষাবিদ হিসেবে হাতে গোনা দু–চারজনের বেশি কারও নাম মনে করতে পারি না। তার মানে কী? অন্যদের নাম কি সত্যি মনে পড়ে না! না, ঠিক তা নয়। মনে পড়ে।
দুঃসংবাদের মধ্যে, ওই দু–চারজনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের হুবহু বিপরীত চরিত্রের বেশ কয়টি নামও মনে পড়ে। মনে না পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় আজকের এই নাজুক অবস্থায় কীভাবে এল, তার কারণ বের করা কঠিন।
একটু পেছনে তাকাই। চিরদিন এমন ছিল না আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের পুরোনো চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গত শতকের সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকের কিছুদিন পর্যন্ত ধরা যায় ধারে-ভারেই এগিয়েছে এই উচ্চশিক্ষার অঙ্গনটি। সোনালি সেই যুগের শেষে ক্রমাগত পথ হারিয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। কেন?
যেসব অধ্যাদেশ মোতাবেক দেশের গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে, তা বেশ খাঁটি গণতান্ত্রিক। খুবই জরুরি পরিস্থিতির উদয় না হলে উপাচার্য মহোদয়ের একক ক্ষমতাবলে কিছু করার কথা কোথাও লেখা নেই এসব অধ্যাদেশে। কিন্তু নেই তো কী হয়েছে! জরুরি পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে অনেকেই তা করেছেন। এখানেই ওই হাতে গোনা পুরোনোদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য।
এই পার্থক্য লেখাপড়ায়, ব্যক্তিত্বে, বিবেকে, সততায়, যোগ্যতায় এবং আরও ঢের অনেক কিছুতে। আর এই পার্থক্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের অবস্থার আসল কারণ।
সব কারণ ছোট এই পরিসরে টেনে আনা সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে হয় দেশের একমাত্র বিদ্যাপীঠ, যেখানে উপাচার্য হওয়ার একটা অলিখিত অথচ অন্যতম অবশ্যপালনীয় শর্ত হয়ে পড়েছে—তাঁকে চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া কেউ হতে হবে। তাতে সমস্যা কি? না না, কোনো সমস্যা নেই, যদি তিনি যোগ্য হন। তারপর?
পরের যোগ্যতা হচ্ছে, তাঁকে অবশ্যই অলিখিত, চট্টগ্রামের কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সক্রিয় অনুসারী বা আদর্শ বা চেতনায় পরিপুষ্ট হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যর সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্ক কী, তা আমি পরিষ্কার জানি না।
অধিকন্তু এই প্রতিনিধিদের স্নেহধন্য হওয়ার পরও অন্তরালে আছে আরও বেশ কিছু ‘ধ্রুপদি’ স্তর, যেগুলো পার না হলে তিনি লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন না—চট্টগ্রাম উত্তর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, বিভাগ, জেলা, নগর ইত্যাদি। অর্থাৎ আপনি কোন অঞ্চলের এবং সেই সূত্র ধরে আপনি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কাকে তুষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেবেন, তা শুরুতেই বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু সিদ্ধান্ত নিলেই চলবে না; আপনাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির অনুসারী ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমেই আকাঙ্ক্ষিত নেতার শরণাপন্ন হতে হবে।
বলে রাখা ভালো, এতে কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের তেমন কোনো স্বার্থ নেই। তাঁরা বরং এ–ই ভেবে খুশি যে, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের জ্ঞানী–গুণী মানুষেরা তাঁদের পেছনে ঘুরছেন, মন্দ কী!
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে—একজন নামী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ একবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীতিনির্ধারণী মহলের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে কি চট্টগ্রামের স্থানীয় সন্তান হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই? উত্তরে তিনি আশ্চর্যান্বিত না হয়েই নাকি বলেছিলেন, না, নেই তো! কেন?
শিক্ষাবিদ আরও জানতে চান, স্থানীয় বা অস্থানীয় হোক, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য পদায়ন করার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বের করা কি সরকারের জন্য কঠিন? তাঁর উত্তর, ‘তা কঠিন নয়। কিন্তু স্যার, যত যোগ্যই হোন, তিনি স্থানীয় না হলে চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধি ও তাঁদের অসংখ্য সক্রিয় অনুসারীর সাহায্যে উপাচার্যের দৌড়ে এগিয়ে থাকা অন্যরা তাঁকে পদচ্যুত করার আন্দোলনে নামবেন, বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেবেন। তার চেয়ে প্রতিষ্ঠানটি কোনোরকমে সচল রাখাটাই কি জরুরি নয়!
শিক্ষাবিদ বিদায় নেওয়ার আগে ঢোঁক গিললেন, সঙ্গে ছাড়লেন একটা সুদীর্ঘ শ্বাস। হয়তো ভাবলেন, তাহলে আর এর নাম বিশ্ববিদ্যালয় রাখার দরকার কী? এত বড় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি কোনোরকমে সচল রাখার বস্তু?
যেকোনো স্বায়ত্তশাসিত, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য কী, তা ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী সবাই কমবেশি ভালো করেই জানেন। শুধু সদিচ্ছা থাকলেই এসব প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের দরজায় উপাচার্য হওয়ার জন্য এভাবে ধরনা দিয়ে বেড়ানোর দরকার হয় না। দিলে বিশ্ববিদ্যালয় এতিমখানায় পরিণত হয়।
ভাবছেন সিনেট কর্তৃক তিনজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ প্রশাসক-গবেষকের নামের প্যানেল আচার্য মহোদয় বরাবর পাঠিয়ে উপাচার্য নিয়োগের নিয়ম রক্ষা করলেই তো আর সমস্যা থাকে না। আরে বাবা, এ কথা তো সবাই জানেন। কাগজে লিখেছেনও বহু গুণীজন। কাজ কি হয়েছে কিছু? কিচ্ছু না। তাহলে সমাধান?
সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতেই। তাঁরা প্রায় সবাইই জানেন, কে কে বা কোন কোন যোগ্য লোক বিশ্ববিদ্যালয়টি সঠিক–সফলভাবে পরিচালনা করতে পারেন। আবার তাঁরা এ–ও জানেন, ওই মুষ্টিমেয় যোগ্য ব্যক্তির কেউই উপাচার্য, সহ–উপাচার্য হতে পারবেন না। তাহলে?
সবই যখন সবাই জানেন, তখন সমাধানের পথ কেন আমরা বাতলাই না? সমস্যা ও সমাধানের পথ জেনেও যদি কোনো জনগোষ্ঠী সন্নাসীর মতো নীরব হয়ে যান, তবে আর কোনো কিছুর সমাধান হবে না।
তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয় অনিয়মমুক্ত হোক, তা আমরা চাই না? এমন প্রশ্নে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে কেমন যেন আরও নীরব হয়ে যাই। ‘দ্য হিউম্যান বিয়িং ইজ ড্রিভেন বাই হিজ/হার ওন ইন্টারেস্টস’—মনুষ্য সন্ততি নাকি তার নিজের স্বার্থ মাথায় রেখেই নিজেকে পরিচালিত করে। বড় বড় পণ্ডিত তাই–ই বলেন।
কিন্তু মানুষ যে সমাজে বসবাস করে, সেই সমাজকে অস্বীকার করে শুধু নিজ নিজ স্বার্থকেই প্রাধান্য দিলে দিন শেষে সমাজ ওই স্বার্থপরকে কীভাবে মূল্যায়ন করে?
একটি প্রশ্ন যে কেউ আমাকে করতে পারেন—চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে এত এত দুর্বার আন্দোলনের খবর আপনি রাখেন না? সবিনয় নিবেদন, অবশ্যই রাখি। যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষক-শিক্ষিকার ২ শতাংশও নন। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, ভালো কাজে তো খুব কম লোকই অংশ নেন। মেনে নিলাম, তা নেয় বৈকি। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এমন আন্দোলন অতীতেও কম হয়নি। সেখানেও উপস্থিতি ছিল এখনকার মতোই।
কিন্তু কেন? কারণ, ব্যানার। যাঁরা আন্দোলন করেন, তাঁরা কোনো একটি দল বা উপদল এবং আদর্শের ব্যানারে আন্দোলন করেন। আন্দোলন সফল হলে এই ব্যানারের একজনই উপাচার্য পদে বসেন। সময় গড়ায়। নতুন উপাচার্য সাহেব বা মহোদয়া কিছুটা পুরোনো হন। নিজ স্বার্থ এবং স্নেহধন্যদের প্ররোচনায় আগের উপাচার্যর মধুর ভুলগুলো তিনি আরও বিস্তৃত পরিসরে সম্পন্ন করতে থাকেন। ত্বরান্বিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের অবনমনের প্রক্রিয়া। আবার নতুন ব্যানার আর আদর্শের বাহার ফিরে আসে। শুরু হয় একই নাটক। নতুন প্রদর্শনী!
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার আর ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যানারের দরকার আছে বৈকি! পুরোনো, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যানার, স্লোগান আর আদর্শ নিয়ে সদা সরব থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় যদি তা নকল করে জীবন ধারণ করতে থাকে, তাহলে একে তো আর যা–ই হোক জ্ঞানীগুণী মানুষের প্রতিষ্ঠান বলা যায় না। যাঁরা সদা জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত, দেশের প্রচলিত এই বা সেই রাজনৈতিক আদর্শ আঁকড়ে ধরার কোনো প্রয়োজন কি আছে তাঁদের?
যেকোনো স্বায়ত্তশাসিত, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য কী, তা ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী সবাই কমবেশি ভালো করেই জানেন। শুধু সদিচ্ছা থাকলেই এসব প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের দরজায় উপাচার্য হওয়ার জন্য এভাবে ধরনা দিয়ে বেড়ানোর দরকার হয় না। দিলে বিশ্ববিদ্যালয় এতিমখানায় পরিণত হয়।
আর তথাকথিত কোনো ব্যানার ও আদর্শ ছাড়াই আমরা যদি সোচ্চার হই, তবে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে—এমন আশা করা অসংগত নয়। আমরা যখন সৎ, নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে সচেষ্ট শিক্ষক, গবেষক ও প্রশাসনে অভিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিদের চিনি, তখন আর কেন সরকারের দরজায় গিয়ে নতজানু হওয়া! কেন এমন অবহেলার স্বীকার হওয়া!
অল্প কয়জন যোগ্য ব্যক্তির ভেতর থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তা করতে প্রচলিত পদ্ধতি কাজ না করলে নতুন কোনো পদ্ধতি বের করার জন্য আলোচনা জরুরি। আর একবার সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও আর কঠিন হবে না।
অন্তত ২৮ হাজার ছাত্রছাত্রীর আকর এত বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমাদের এমন উদ্যোগের বিকল্প কী হতে পারে! বিকল্প থাকলে তা নিয়েও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই যুক্তিতর্কে বসবেন। সমাধান বের করবেন। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধানে বাইরের কারও দয়াদাক্ষিণ্যের পানে চেয়ে থাকাটা অযৌক্তিক।
‘বলি কী, আমরা ফিরে গিয়ে গোড়াটা হয়তো বদলাতে পারি না, কিন্তু অগত্যা যেখানে এসেই পড়েছি, সেখান থেকে যাত্রা করতে পারি আর শেষটা তো বদলে দিতে পারি।’ বিশ্ববিদ্যালয়টি এভাবে শেষ হওয়ার আগেই তাকে জানে বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়ার সময় এখনই।
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই–মেইল: zahidhistory@gmail.com