কয়েক দিন আগে সদ্যবিদায়ী নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে কথা হয় তাঁর সরকারি বাসভবনে। সঙ্গে ছিলেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রিয়াদুল করিম। আলোচনার বিষয়বস্তু রাজনীতি, গণতন্ত্র, আমলাতন্ত্র, নির্বাচনী কাঠামো ইত্যাদি।
সমকাল-এ কাজী হাবিবুল আউয়াল ‘বিপ্লব ও ফরমান: সরকার ও সংবিধান’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেন, যা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকের প্রশ্ন ছিল, কেন তিনি এটা লিখেছেন। তার ব্যাখ্যাও কিন্তু কাজী সাহেব দিয়েছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংকটে। আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কমিশনের প্রধান হিসেবে পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন মনে করছি। ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে।’
তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, রাজপথের এই বিপ্লবের বৈধতা কে দেবেন? দুই সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ সংবিধান স্থগিত করে দেশ শাসন করেছেন। পরে তাঁরা সেই শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন যথাক্রমে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে।
এবার সংসদ ভেঙে দেওয়া হলেও সংবিধান বহাল আছে। সংবিধানের আওতায়ই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা আছে। সেই বাধ্যবাধকতা না মানলে, সেটা হবে রাষ্ট্রদ্রোহ।
তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নির্বাচন কমিশনের সংকট কাটাতে আপনি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করলেন না কেন? জানালেন, রাষ্ট্রপতি তাঁকে বা কমিশনকে সাক্ষাৎ দেননি। প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়েও তাঁরা পাননি।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের দাবি ওঠে। বৃহস্পতিবার যখন কাজী হাবিবুল তাঁর সহযোগীদের নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন, তখনো নির্বাচন ভবনের বাইরে বিক্ষোভ চলছিল। পদত্যাগ ঘোষণার আগে ‘বিদায়ী ব্রিফিং’-এ ভবিষ্যতের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দেন সাবেক সিইসি। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়ভিত্তিক) নির্বাচনেরও প্রস্তাব দেন। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলই আনুপাতিক ভোটের পক্ষে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন কাজী হাবিবুল। প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর নাম প্রস্তাব করলে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।
সাবেক সিইসি অতীতের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালের নির্বাচন হয় সামরিক শাসনের অধীন এবং ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচন রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন হয়েছিল। ১৯৯৬ ১২জুন) ও ২০০১ সালের নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন, সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আউয়াল কমিশন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের ডেকেছিলেন পরামর্শের জন্য। সে সময় অনেকেই আগের দুটি নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, কমিশন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে না পারলে তাদের উচিত হবে অপরাগতা প্রকাশ করে পদত্যাগ করা। হাবিবুল আউয়াল সে সময় যুক্তি দিয়েছিলেন, পদত্যাগ করা বা অপারগতা প্রকাশের সুযোগ নেই।
বিদায়ের দিনও তিনি বললেন, ‘নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন, কী কারণে, কত দিনের জন্য স্থগিত করা যাবে, তা-ও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেননি।
অবশ্য সাবেক সিইসি স্বীকার করেছেন, সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে; দলের মধ্যে নয়।
নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা হয়েছে নির্বাচন পরিচালনার জন্য। নির্বাচন মানে বাছাই করার উন্মুক্ত সুযোগ। বহুদলীয় গণতন্ত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাকে নির্বাচন বলা যায় না। যেখানে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে প্রতিযোগিতা করার প্রার্থীই পাওয়া গেল না, সেখানে কীভাবে নির্বাচন হলো?
এই বিবেচনায় তাঁরা ৭ জানুয়ারি যেটি করেছেন, সেটা কোনোভাবে নির্বাচনের সংজ্ঞায় পড়ে না। কাজী রকিব কমিশন ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিযোগিতায় ভোট করে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। কে এম নুরুল হুদা কমিশন দিনের ভোট রাতে করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছিল।
এই পটভূমিতে আউয়াল কমিশনের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, তারা হয়েতা পূর্বসূরীদের পথে হাঁটবে না। শেষ পর্যন্ত এই কমিশনও ‘আমি–ডামির’ নির্বাচন করে দেশকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিল। তবে আউয়াল কমিশনের শুরুটা ছিল অনেকটা ইতিবাচক। তাঁরা ভোটচুরির অভিযোগে গাইবান্ধা উপনির্বাচন পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। এ জন্য তাঁরা সরকারের বিরাগভাজনও হয়েছিলেন।
২০১৮ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আউয়াল কমিশনের সামনে বড় প্রশ্ন ছিল, তারা ক্ষমতাসীনদের সাজানো আরেকটি নির্বাচনে যুক্ত হবে কি না। এ নিয়ে সাবেক সিইসির মনেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তিনি বলেছেন, বিএনপির মতো বড় দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলে সেটি আইনের চোখে বৈধতা পেলেও ন্যায্যতা পাবে না।
কেএম হুদা কমিশনের ভিন্নমতাবলম্বী কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি যখন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারছেন না, তখন পদত্যাগ করলেন না কেন?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একা পদত্যাগ করলে নির্বাচন তো বন্ধ হবে না।’
তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের পর দেশে নতুন করে নির্বাচনী সংকট শুরু হলেও আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালে একটি সুযোগ পেয়েছিল। এই নির্বাচনে আপত্তি সত্ত্বেও বিএনপিসহ সব বিরোধী দল অংশ নেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা ‘দিনের ভোট রাতে করে’ এবং বিএনপিকে মাত্র ৬টি আসন দিয়ে গণতন্ত্রের বুকে ছুরি বসিয়ে দিল।
এরপর বিরোধী দলগুলো যৌক্তিকভাবেই মনে করল, আওয়ামী লীগের অধীন কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ২০২৪ সালে বিএনপি যেমন নিজেদের জয় সম্পর্কে অবিচল ছিল, ২০১৮ সালে সেটি ছিল না। সে সময়ে তারা বিরোধী দল হিসেবে সম্মানজনক অবস্থান চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেটুকুও দিতে রাজি হয়নি। এর পেছনে একজন সাবেক আমলার কারসাজি ছিল বলে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যে বলেছেন। কিন্তু সেই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেননি। এর পেছনে ছিল দুই তৃতীয়াংশ আসনের দম্ভ।
ভবিষ্যতে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন, কোনো দল যাতে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে নিজেদের বাংলাদেশের স্থায়ী জমিদার না ভাবতে পারে, সে রকম আইনি সুরক্ষার কথা ভাবতে পারেন সংস্কারের প্রবক্তারা।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বিদায়ী ভাষণে বলেছেন, এ দেশে দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এ কারণে তিনি দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো সংহত করতে নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়া উত্তম। ৭ জানুয়ারির আগে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা এই সত্য উপলব্ধি করলে হয়তো ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য এতগুলো মানুষকে জীবন দিতে হতো না। আওয়ামী লীগকেও লজ্জাজনকভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হতো না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক