৫ আগস্টের ঐতিহাসিক আন্দোলনের চার সপ্তাহব্যাপী নাটকীয় সমাপ্তি শুধু বাংলাদেশকেই নাড়া দেয়নি, বিশ্বব্যাপী নাড়া দিয়েছে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে। কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ একটি আন্দোলন সরকারপ্রধানের বিস্ফোরক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আরেক পর্যায়ে চলে যায়।
দলীয় বাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে চরমভাবে বলপ্রয়োগ করে মোকাবিলা করতে গিয়ে সেই আন্দোলনে তৈরি হয় সহিংসতা ও সংঘর্ষ। এ সময় ঘটে বিপুল প্রাণহানি। পরিশেষে সেই আন্দোলন গড়ায় সরকার পতনের এক দফা দাবির আন্দোলনে।
নিজের ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কয়েক সপ্তাহ ধরে কঠোর কথাবার্তার পর শেখ হাসিনার দেশত্যাগের বিষয়টি এতটাই নাটকীয় ও দ্রুত ছিল, যা কেবল তাঁর দেশের জনগণকেই বিস্মিত করেনি; বরং সবচেয়ে বিস্মিত করেছে তাঁর ঘনিষ্ঠ দলীয় নেতাদের, যাঁরা তাঁকে পুরোপুরি সমর্থন করেছিলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পরপরই তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে বিক্ষুব্ধ জনতা ব্যাপক অভিযান চালায়। যার ফলে তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসপত্রসহ অতুলনীয় লুটপাট ও সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করা হয়।
কিন্তু শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও হিংস্র আবেগ গণভবন লুণ্ঠনের মধ্যেই থেমে থাকেনি, তা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন থেকে অনেক দূরে তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি অগ্নিসংযোগে পৌঁছেছিল, যা জাতীয় জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছিল। এই ক্ষোভের সবচেয়ে দুঃখজনক অভিব্যক্তি ছিল বিশাল ক্রেনের সাহায্যে কুঠারধারী একদল বিক্ষোভকারীর সম্মিলিত আক্রমণে শেখ মুজিবের একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি ভেঙে ফেলা, যা অন্যরা দেখছিল ও করতালি দিচ্ছিল। বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না।
এসব ক্ষোভ ও ক্রোধের ঘটনার একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ জনতা দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতা ও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ লোকজনের বাড়িঘরে হামলা চালায়। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের বাড়িঘর লুট বা ধ্বংস করা হয়। তারা জীবন বাঁচাতে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান, যেমন গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
কয়েক সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও সরকার পতনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এটা কি শুধু ছাত্রদের অধিকারের জন্য আন্দোলনে বলপ্রয়োগ করার ফল? কেন একটি জনগণ শুধু শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিই নয়, দেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত একজন নেতার বিরুদ্ধেও এত প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে? এর কারণ কি শেখ মুজিব তাঁর পিতা?
আমার মতে অপরাধী হচ্ছে, ৫৩ বছর ধরে একের পর এক পক্ষপাতদুষ্ট সরকার দ্বারা শাসিত জাতির সম্মিলিত দায়িত্বহীনতা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যেসব সরকার ছিল, তারা ছিল দুটি সামরিক শাসন (যদিও ছদ্ম গণতন্ত্রে), তারপরে দুটি পারস্পরিক বিরোধী রাজনৈতিক দল। কোনো সরকারই দেশের ‘প্রতিষ্ঠাতা’ হিসেবে আমাদের কাকে মুকুট দেওয়া উচিত, সে প্রশ্নে কখনোই নিষ্পত্তি করেনি।
কোনো সরকারই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিবের লিপিবদ্ধ ইতিহাস এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রামে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার কথা পরের প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে একটি দলের নেতা হিসেবে না দেখিয়ে দেশের নেতা, দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে দেখাতে পারেনি। বরং গত ১৫ বছর দেশের নেত্রী তাঁর পিতাকে তাঁর দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর দলকে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র দাবিদার হিসেবে স্লোগান দিয়ে আসছেন। এভাবে তিনি শুধু নিজেকেই জনসাধারণ থেকে দূরে সরিয়ে নেননি, বঙ্গবন্ধুকেও দলীয়করণ করেছেন।
আমাদের সংবিধানে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আমরা সত্যিকার অর্থে অনুসরণ করিনি। একের পর এক আমাদের নেতারা এসব নীতিকে ক্ষয় করতে দিয়েছিলেন। আমরা একটি সন্দেহজনক জাতীয়তাবাদ অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি, আমরা আসলে কে (বাঙালি বা মুসলমান), তা জানি না।
আমরা কিছু চর্চা না করে সমাজতন্ত্রের চেষ্টা করেছি। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা ছেড়ে আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে গ্রহণ করেছি (আওয়ামী লীগ সুযোগ পেয়েও তা পরিবর্তন করেনি)। এরপর আমরা চূড়ান্তভাবে এক দল ও তাঁর নেতাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়েছি।
শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি এবং শেখ মুজিবের বাড়ি পোড়ানো, তাঁর ভাস্কর্য ও ম্যুরালগুলো ভাঙার ঘটনাগুলোর সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একই বাড়িতে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারকে হত্যার পর যা ঘটেছিল, তার মধ্যে কিছু অমিল খুঁজে পাই।
১৫ আগস্ট বিকেলে ৩২ নম্বর রোডের পরিত্যক্ত বাড়ির পাশে আমি গিয়েছিলাম দেখার জন্য (আমি তখন ধানমন্ডিতে থাকতাম)। মিরপুর রোডে থাকা একটি ট্যাংক ছাড়া বাড়িটি পাহারা দেওয়ার মতো একজনও ছিল না।
ঘোষণা অনুযায়ী কারফিউ বলবৎ থাকলেও ওই এলাকায় দৃশ্যমান কোনো সেনা উপস্থিতি ছিল না। মাইলখানেক দূরে নিউমার্কেটে লোকজন তাঁদের দৈনন্দিন কাজ করে কেনাকাটা করছিল।
এই হত্যাকাণ্ডে তারা একটুও বিচলিত হয়নি বলে মনে হয়েছে। আমিসহ কিছু মানুষ হতবাক হয়েছিল, কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যার প্রতিবাদ বা অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থনে কোনো মিছিল না। সেদিন শেখ মুজিবের বা তাঁর সমর্থকদের বাড়ি লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি।
শেখ মুজিব একটি রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন, কিন্তু তিনিই ছিলেন সেই নেতা, যিনি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আমাদের এই দেশ দিয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কন্যা তাঁর উত্তরাধিকার ধরে রাখতে পারেননি। কারণ, তিনি দল–মতনির্বিশেষে বাঙালি দ্বারা অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে তাঁর দলের একক অর্জন হিসেবে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সবাই।
কিন্তু এবার দৃশ্যপট পাল্টে গেল। তাঁর শাসনের অবসান উদ্যাপন করতে জনগণ বিপুলসংখ্যায় বেরিয়ে এসেছিল। তারা শেখ হাসিনাকে না পেয়ে তাঁর বাবার ওপর প্রতিশোধ নেয়। তাঁর বাবার মূর্তি, ম্যুরাল ও জাদুঘরটি, যা একসময় তাঁর বাড়ি ছিল, তা ধ্বংস করে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন যে সম্পত্তির ওপর জনতার আক্রমণে মানুষ তার স্বতন্ত্র পরিচয় হারিয়ে ফেলে এবং অন্যদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। তারা উন্মাদ হয়ে যায় এবং জনতার অংশ হয়ে যায়।
কিন্তু এই মনস্তত্ত্ব কি আমাদের ভবিষ্যৎ পরিচালনা করবে? এই দেশের প্রতিষ্ঠাতারা কিসের জন্য লড়াই করেছিলেন? শেখ মুজিব একটি রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন, কিন্তু তিনিই ছিলেন সেই নেতা, যিনি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আমাদের এই দেশ দিয়ে গেছেন।
দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কন্যা তাঁর উত্তরাধিকার ধরে রাখতে পারেননি। কারণ, তিনি দল–মতনির্বিশেষে বাঙালি দ্বারা অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে তাঁর দলের একক অর্জন হিসেবে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সবাই। একটি গোটা জাতির অর্জনকে আপনি নিজের বলে অপব্যবহার করতে পারেন না। ১৯৭৫ ও ২০২৪ সালে মানুষ এই বার্তাই দিতে চেয়েছিল।
প্রত্যেক জাতি তার স্বাধীনতার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে সম্মান করে। কেউ কেউ তাঁদের জাতির পিতা বলে অভিহিত করেন। জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের পিতা। কামাল আতাতুর্ক আধুনিক তুরস্কের জনক। গান্ধীকে ভারতের জনক হিসেবে সম্মান করা হয়। এসব জাতির ইতিহাসে সরকারগুলো পরিবর্তিত হয়েছে। তবে যা অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে তা হলো, তাদের প্রতিষ্ঠাতার নাম।
সুতরাং বিগত সরকারের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত ক্ষোভ ও ক্রোধের এই সময়ে আসুন আমরা আমাদের দেশের বিপথগামী একজন স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে আক্রোশ যেন দেশের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে পরিচালিত না করি।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি ও বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা