স্বৈরাচারের ১৬ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশের নামে যা হয়েছে, তা দুর্নীতি আর লুটপাট। প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লাখ লোক চাকরির বাজারে ঢুকেছেন। আমরা বসে আছি বেকারত্ব নামের বোমার ওপর।
অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে আমাদের উত্তরণের শক্তিশালী উপায় হতে পারে স্টার্টআপ। প্রযুক্তির সহায়তায় প্রচলিত রীতিনীতি অতিক্রম করে নতুন কিছু করাই স্টার্টআপের বৈশিষ্ট্য। এখানে প্রবৃদ্ধি হয় দ্রুত, ঝুঁকিও বেশি।
বাংলাদেশে স্টার্টআপের ইতিহাস দেড় দশকের। ২০১০ সালে বিকাশ দিয়ে এর যাত্রা শুরু। ১২ থেকে ১৩ বছরে বিনিয়োগ এসেছে ১ বিলিয়ন ডলারের কম। আবার এই বিনিয়োগ সরাসরি দেশের স্টার্টআপে না এসে, একটি বড় অংশ এসেছে বিদেশে তাদের হোল্ডিং কোম্পানিতে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্টার্টআপ উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু ভাবার অবকাশ আছে। সেগুলো নিয়ে কিছু কথা নিচে দেওয়া হলো।
১. নেশন ব্র্যান্ডিং: বিশ্বের সাধারণ নাগরিকের কাছে বাংলাদেশের তেমন পরিচিতি নেই। যদি থাকেও, সেটা মূলত নেতিবাচক-প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দরিদ্র দেশ। সঙ্গে যোগ হয়েছে বিগত অগণতান্ত্রিক সরকারের তকমা। অবশ্য কয়েক দশক ধরে ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। আমরা এখন ড. ইউনূসকে ব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারি। বিনিয়োগ বা সেবা রপ্তানির ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী বা ক্রেতা প্রথমে ‘দেশ’-এর রেটিং বিবেচনা করে। কোনো কোম্পানি সম্পর্কে বিবেচনা আসে দ্বিতীয় স্তরে।
২. ইনকিউবেশন: একজন উদ্যোক্তার আইডিয়া ব্যবসায় পরিণত করা বিশাল কাজ। আর প্রথম উদ্যোগ হলে তা হয় সম্পূর্ণ অচেনা ও বন্ধুর। তাদের প্রয়োজন হয় অর্থ, জায়গা, তথ্য, মানবসম্পদ ইত্যাদি। প্রয়োজন বুদ্ধি, পরামর্শ, জ্ঞান ও নেটওয়ার্ক। একজন তরুণ ও নবীন উদ্যোক্তার পক্ষে এসব জিনিস জোগাড় করা সম্ভব নয়।
ইনকিউবেশন সেন্টার নবীন উদ্যোক্তাকে হাতেকলমে সহায়তা করে। শিক্ষকেরা বুদ্ধি ও পরামর্শ দেন। ইনকিউবেশন সেন্টারগুলো সাধারণত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে থাকে। এই সেবার বিনিময়ে স্টার্টআপের পক্ষে অর্থ প্রদান করা সম্ভব না হলে শেয়ার দেওয়ারই প্রচলন।
৩. ফান্ড অব ফান্ড: স্টার্টআপরা যেখান থেকে পুঁজি পায়, সেখানে সাধারণত বিনিয়োগকারীকে কোম্পানির শেয়ার দিতে হয়। এই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলো অর্থ পায় লিমিটেড পার্টনার থেকে। তাঁরা হতে পারেন কোনো বিত্তশালী ব্যক্তি, সংস্থা, পেনশন ফান্ড, প্রভিডেন্ট ফান্ড, করপোরেট, ব্যাংক, বিমা বা অন্য কোনো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা প্রাইভেট ইকুইটি ফান্ড। কিছু ফান্ড সরাসরি স্টার্টআপে বিনিয়োগ না করে অন্য কোনো ভেঞ্চার ফান্ডে বিনিয়োগ করে। এতে তাদের সুবিধা দুটি—ঝুঁকির বিস্তার, দ্বিতীয়ত লিভারেজ, ভেঞ্চার ফান্ড আরও অর্থ জোগাড় করে তার উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তা করে।
ভারতে স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বা সিডবি ৫০০০ কোটি রুপির অধিক ফান্ড চালু করেছে, যা এসএমইতে বিনিয়োগকারী ফান্ডদের অর্থায়ন করে, ফান্ড অব ফান্ড হিসেবে। শর্ত থাকে, সেই ফান্ড সিডবির দেওয়া অর্থের সমপরিমাণ বা তারও বেশি জোগাড় করবে এবং তা এসএমইতে বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশে ফান্ড অব ফান্ড নেই, তাই ভেঞ্চার ফান্ডের টাকা জোগাড় করতে বেগ পেতে হয়।
প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লাখ লোক চাকরির বাজারে ঢুকেছেন। আমরা বসে আছি বেকারত্ব নামের বোমার ওপর।
৪. অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর: কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি আইডিয়া, সিড বা প্রাথমিক পর্যায়ে বিনিয়োগ করে থাকেন, তাঁদের অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বলে। তাঁদের বিনিয়োগ করা টাকার পরিমাণ কম থাকে। বাংলাদেশেও অনেক অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর আছেন। বাংলাদেশ অ্যাঞ্জেল নেটওয়ার্ক নামে তাঁদের একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল। সেটি এখন ততটা সচল নয়। স্টার্টআপে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের বিনিয়োগ আয়করের জন্য গ্রহণযোগ্য বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
৫. নিয়মনীতি: উদ্ভাবনের জন্য নিয়মনীতি শিথিল করা যেতে পারে। পেনশন ফান্ড, প্রভিডেন্ড ফান্ডের অর্থ ভেঞ্চার ফান্ডে বিনিয়োগের ব্যাপারে ট্রাস্ট আইন ও আয়কর আইনে পরিবর্তন আনা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার একটি স্টার্টআপ ফান্ড গঠন করেছে ৩ বছর আগে। ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে তাদের লাভের ১ শতাংশ অর্থ দিয়ে আরেকটি স্টার্ট ফান্ড তৈরির জন্য। সেই ফান্ড থেকে সামান্য টাকা ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ, ভুলনীতি।
স্টার্টআপদের প্রয়োজন পুঁজি। অথচ পলিসিতে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক পুঁজি বিনিয়োগের সঠিক প্রতিষ্ঠান নয়। এই নীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অনুমোদিত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডে কেউ বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত দেওয়া প্রয়োজন।
৬. এক্সিট: ভেঞ্চার ক্যাপিটাল স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে কয়েক গুণ মুনাফার প্রত্যাশায়। সেই মুনাফা আসে বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। একে বলে এক্সিট। এই বিক্রি হয় বিভিন্নভাবে যেমন আইপিও, অন্য কেউ কিনে নেওয়া অথবা উদ্যোক্তা কিনে নেওয়া। বাংলাদেশে এখনো স্টার্টআপ আইপিওতে যেতে পারেনি। তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারী তার মুনাফা বা পুঁজির টাকা ফেরত নেওয়া ঝামেলাবিহীন হতে হবে।
৭. সরকারি সহায়তা: সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্টার্টআপরা বিভিন্ন কারণে অযোগ্য হয়ে যায়; যেমন নির্দিষ্ট অঙ্কের লেনদেনের রেকর্ড, বড় কাজ করার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ‘স্টার্টআপ ফার্স্ট’ নীতি চালু করা উচিত। বিদেশি সফটওয়্যার বা সার্ভিসের প্রতি আমাদের অনুরাগ বের হয়ে মেধার ভিত্তিতে ক্রয় করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
স্টার্টআপের অর্থায়ন ৯০ শতাংশের বেশি এসেছে বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে। কিছু কিছু স্টার্টআপ তাদের সেবা দেশের বাইরেও দিতে পারে। যেমন পাঠাও নেপালে বিস্তার করেছে। এর জন্য আমাদের দূতাবাসের সহযোগিতা প্রয়োজন।
৮. করপোরেট লিংকেজ: করপোরেটদের পক্ষে উদ্ভাবন দুরূহ। কারণ, উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজন স্বাধীনতা ও শিথিল নিয়মকানুন। স্টার্টআপরা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদের কোনো আইডিয়া কাজ না করলে নতুনভাবে শুরু করতে পারে। তাদের ব্যয়ও অনেক কম। করপোরেটরা তাই স্টার্টআপের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করলে উভয়ের লাভ হবে। বিদেশে করপোরেটরা ভিসি ফার্মের মাধ্যমে তাদের কৌশলগত সুবিধার স্টার্টআপে অর্থায়ন করে। বাংলাদেশেরা করপোরেটরা সেভাবে চিন্তা করতে পারে।
৯. সচেতনতা: স্টার্টআপদের সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ভয় ও আশঙ্কা আছে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার বড় ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেয়। মিডিয়া সে ক্ষেত্রে স্টার্টআপদের ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরতে পারে।
১০. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংযোগ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেধাবী ও দক্ষ জনবল তৈরি করে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য স্টার্টআপ তৈরি করে চাকরির বাজার। তা ছাড়া ইনকিউবেশনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাথমিক পর্যায়ে স্টার্টআপকে সহায়তা দিতে পারে। বিনিময়ে তারা স্টার্টআপ থেকে শেয়ার পেতে পারে।
তবে সর্বোপরি, স্টার্টআপ এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অতি প্রয়োজনীয়। এই জন্য সরকারকে ‘স্টার্টআপ নেশন’ হওয়ার প্রত্যয় নিতে হবে। নিতে হবে সেই অনুযায়ী উদ্যোগ ও কার্যক্রম।
শওকত হোসেন প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিমিটেড ও সভাপতি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।