মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু একটি বিতর্ক এখন বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। তা হলো মিয়ানমারকে কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাণিজ্য সুবিধা দেওয়া উচিত? সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ইউরোপ ও মিয়ানমারের অনেক ট্রেড ইউনিয়ন মিয়ানমারকে ইইউ-এর এভরিথিং বাট আর্মস বা ইবিএ (অস্ত্র বাদে আর সব পণ্য) বাণিজ্য প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ইউরোপের বাজারে নির্দিষ্ট কিছু রপ্তানি পণ্য কোটা ও শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশের সুবিধা পায়।
অন্যদিকে ইইউ ও বাকি বিশ্বের অনেক বিশ্লেষক যুক্তি দেখাচ্ছেন, ইবিএ প্রকল্প থেকে মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে দিলে তার প্রভাব প্রধানত দেশটির নারী শ্রমিকদের প্রাধান্যে পরিচালিত তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর পড়বে। রপ্তানিমুখী এই শিল্প ইতিমধ্যে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত জান্তা সরকারের আয়ের উৎস বন্ধ করতে পারবে না।
২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। এর কয়েক দিনের মধ্যে মিয়ানমার ইবিএ সুবিধা পাবে কি না, সে বিষয়ে তদন্তের জন্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হয়। এ মাসে ইউরোপীয় আইনপ্রণেতারা ইউরোপিয়ান কমিশনের কাছে মিয়ানমারের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, মুখে শক্ত কথা বললেও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র নরম অবস্থান নিচ্ছে।
২০১৩ সালে মিয়ানমারের সাবেক সেনাপ্রধান থিয়েন সেইনের সরকারের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারকে বাণিজ্য সুবিধা দেয়। সে সময়ে দেশটি গণতান্ত্রিক শাসনে আসার পথে ছিল। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও অগ্রসর হলে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রও বেশ কিছু বাণিজ্য সুবিধা দেয় দেশটিকে। সামরিক শাসন ও ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে সেসব সুবিধা বন্ধ রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কেউ কেউ আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর যেন আরও মৌলিক পদক্ষেপ নেয়, সে দাবি জানিয়েছে। তারা মনে করেন, জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) যে ছায়া সরকার গঠন করেছে, সেটিকে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ঐক্য সরকারের ‘জনযুদ্ধে’ আর্থিক সমর্থনও দেওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
পশ্চিমা বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় তৈরি পোশাক খাতে মিয়ানমারের রপ্তানি ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে পাঁচ গুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে এ খাতে রপ্তানি আয় ছিল ৫০২ কোটি ডলার। রপ্তানি আয়ের দিক থেকে মিয়ানমারের তৃতীয় প্রধান খাত পোশাকশিল্প। কোভিড মহামারি শুরুর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছিল মিয়ানমারের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা।
ইউরোপীয় কমিশন মিয়ানমারের ইবিএ সুবিধা থাকবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছে। এরই মধ্যে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে দেশটির নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গৃহযুদ্ধের বিস্তার ঘটছে। মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম আন্ড্রিউসের জুন মাসের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ পর্যন্ত মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে দুই হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৪ হাজার এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৭ লাখের বেশি মানুষ।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট হাইদি হাতালা সম্প্রতি এশিয়া টাইমসকে বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত এমন কোনো আলামত নেই যে ইবিএ সুবিধা সামরিক জান্তার পকেট ভারী করছে। বরং এই সুবিধার কারণে অর্থনৈতিকভাবে খুব বাজে পরিস্থিতিতে থাকা দেশটির নারীদের জন্য তৈরি পোশাকশিল্পে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইতিহাসের পিএইচডি গবেষক জর্জ বাওয়ের মনে করেন, কোভিড মহামারি ও সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে তৈরি পোশাকশিল্পে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। এরপরও এ খাতে এখন প্রায় ২০ লাখ মানুষ কাজ করছেন। এঁদের বেশির ভাগই গ্রামের গরিব নারী।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইবিএ ও জিএসপি প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্যমুক্তি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং এর বিপরীতে দেশগুলো যেন শ্রম ও মানবাধিকার মেনে চলে। অল ইউরোপিয়ান ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লুক ট্রায়াঙ্গল বলেছেন, মিয়ানমার সম্প্রতি ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করেছে। ৩০১ জন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। হত্যার শিকার হয়েছে ৫৫ জন। আইএলও-এর শ্রম বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের কারণে অল ইউরোপিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন মিয়ানমারের ইবিএ সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
ট্রায়াঙ্গল বলেছেন, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার মানবাধিকার। সম্প্রতি মিয়ানমারে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। যেসব বাণিজ্য থেকে সামরিক জান্তা আর্থিক সমর্থন পাচ্ছে, সেগুলো বাছাই করে ইবিএ প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ইইউ অহিংস পদক্ষেপ নিতে পারে। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত শ্রমিক এবং ট্রেড ইউনিয়ন অনিরাপদ থেকে যাবে।
মিয়ানমারকে দেওয়া ইবিএ সুবিধা তুলে নেওয়ার পরিবর্তে ইইউকের আরও শক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন অনেকে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও তাদের পরিচালিত ব্যবসার ওপর ইইউ নতুন কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। ইইউ সর্বশেষ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।
জাস্টিস ফর মিয়ানমার নামের একটি সংগঠন গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন সামরিক বাহিনীর অস্ত্র কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত ৩১ কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর কয়েকটির ওপর এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
কেউ কেউ আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর যেন আরও মৌলিক পদক্ষেপ নেয়, সে দাবি জানিয়েছে। তারা মনে করেন, জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) যে ছায়া সরকার গঠন করেছে, সেটিকে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ঐক্য সরকারের ‘জনযুদ্ধে’ আর্থিক সমর্থনও দেওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
বাউয়ের বলছেন, ইবিএ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তাতে জান্তা সরকারের চেয়ে বিপ্লবকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এ ধরনের বিতর্কিত শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে এমন একটি পদক্ষেপের কথা ভাবা দরকার, যেটি বিপ্লবকে ইতিবাচক সমর্থন দিতে পারে।
ডেভিড হাট, রাজনৈতিক সাংবাদিক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়া বিষয়ে বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ মনোজ দে