গাজায় একটি মহাসুযোগ কাজে লাগানোর পর ইসরায়েল এখন আরেকটি মহাসুযোগ কাজে লাগাতে যাচ্ছে। আর তা হলো লেবাননে একটি যুদ্ধ। যখনই যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়, তখনই ইসরায়েল যেন এক অসীম সুযোগের ভূমিতে প্রবেশ করে। প্রতিটি যুদ্ধই একটি সুযোগ, আর প্রতিটি সুযোগ একটি যুদ্ধ ডেকে আনে।
গাজায় সমস্যা হয়েছে? যুদ্ধই সমাধান। উত্তরাঞ্চলীয় (লেবানন) সীমান্তে সমস্যা দেখা দিয়েছে? আরেকটি যুদ্ধ হোক। বহু ইসরায়েলি এখন বেশ উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। হাজার হোক, তারা তো একরকম একটি সুযোগের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছিল। অন্যরাও একে নীরবে সমর্থন দিচ্ছে একটি নিপীড়নমূলক অবস্থায় পতিত হয়ে। তবে তারা প্রায় সবাই একমত যে আর কোনো বিকল্প নেই।
যুদ্ধকে একটি ভয়াবহ প্রয়োজনীয়তা হিসেবে বিবেচনা করা এক জিনিস আর একে একটি সুযোগ হিসেবে দেখা আরেক জিনিস। একটি নতুন বিশ্ব, নতুন বাস্তবতা, আগের চেয়ে ভালো একটি অবস্থা তৈরি করার সুযোগ যে এটা। হামাস নির্মূল হবে, জিম্মিরা সব ছাড়া পাবে আর হিজবুল্লাহ উপহাসের পাত্রে পরিণত হবে। উত্তরাঞ্চল থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসা ইসরায়েলিরা আবার তাদের বাড়িতে ফিরে যাবে, গ্যালিলেতে ফুল ফুটবে। একই রকম অবস্থা দেখা দেবে গাজা সীমান্তের অধিবাসীদের জন্য। যুদ্ধ কী চমৎকার সুযোগটাই না বয়ে এনেছে!
অথচ সত্যি ঘটনা হলো, ইতিহাসজুড়ে ইসরায়েল এমন একটি যুদ্ধও করতে পারেনি, যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে বা সমস্যার সমাধান করেছে; বরং ১৯৬৭ সালের মতো আরও কিছু যুদ্ধ পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারপরও বলা হয়েছে, পরবর্তী যুদ্ধের জন্য একটু অপেক্ষা করো, যা আমাদের সব সমস্যার সমাধান ঘটাবে এবং তা চিরতরে।
আসলে তো ‘চিরতরে’ এই ‘পরিপূর্ণ বিজয়’ ঘটেছে অতীতে। হামাসকে চিরতরে পরাজিত করা হয়েছে—এটা ধরে নিয়ে ইসরায়েল এবার চিরদিনের জন্য হিজবুল্লাহকে পরাভূত করবে। সমস্যা হলো, এ রকম সবকিছুই শেষ হয় কয়েক বছর শান্ত থেকে আরেকটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, যা আগেরটার চেয়ে খারাপ হয়। লেবাননে একটি বড়সড় যুদ্ধের সমর্থকেরা এখন আইডিএফকে বৈরুতের উপকণ্ঠে দেখার জন্য লালায়িত হয়ে আছে এই দাবিতে যে এটি একটি বিরাট সুযোগ। তারা নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ তৈরি করছে দ্রুত এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য। তাদের যুক্তি এ রকম, পেজার বিস্ফোরণে লেবাননে ৫০০ মানুষ নতুন করে অন্ধ হয়ে গেলেও এটা এমন এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে, যা আর ফেরত পাওয়া না–ও যেতে পারে। তাহলে যুদ্ধ শুরু করতে আর দেরি কেন?
যুদ্ধ একটি সুযোগ বয়ে আনে—এমন ধারণা তো আসলে অসুস্থ মনোভঙ্গির এক প্রকাশ। সমস্যা সমাধানের একমাত্র পন্থা হিসেবে যুদ্ধকে বিবেচনা করা মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। তবে যে দেশে দৈনিক ইসরায়েল হাইমের কলামিস্ট কারিন এলদাদের মতো কেউ যখন লেবাননে পেজার বিস্ফোরণে কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু ঘটা, কয়েক হাজারের আহত হওয়া ও কয়েক শ মানুষের অন্ধত্ববরণের ঘটনাকে ‘(হিব্রু) নতুন বছরের প্রাক্কালে আমাদের জাতির জন্য এক বিরাট উপহার’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারেন, তখন আর কোনো কিছুতে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকে না।
যুদ্ধ একটি সুযোগ বয়ে আনে—এমন ধারণা তো আসলে অসুস্থ মনোভঙ্গির এক প্রকাশ। সমস্যা সমাধানের একমাত্র পন্থা হিসেবে যুদ্ধকে বিবেচনা করা মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। তবে যে দেশে দৈনিক ইসরায়েল হাইমের কলামিস্ট কারিন এলদাদের মতো কেউ যখন লেবাননে পেজার বিস্ফোরণে কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু ঘটা, কয়েক হাজারের আহত হওয়া ও কয়েক শ মানুষের অন্ধত্ববরণের ঘটনাকে ‘(হিব্রু) নতুন বছরের প্রাক্কালে আমাদের জাতির জন্য এক বিরাট উপহার’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারেন, তখন আর কোনো কিছুতে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকে না।
‘উত্তরে আমাদের শত্রুরা যে অসাধারণ আঘাত পেয়েছে, সেটাই তো আমাদের দরকার। এতে যে চমৎকারিত্বের, যে নিখাদ লক্ষ্যভেদ ও নাকাল করার, সর্বোপরি এক লাখ ধাপ এগিয়ে চিন্তা করার সক্ষমতার যে প্রকাশ ঘটেছে, সেটাই তো দরকার,’ কাব্যিক ঢঙে কারিন এলদাদ বলেছেন। অথচ যেকোনো জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে যুদ্ধ রক্তপাত, ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর কোনো কিছুর সুযোগ নয়।
যারা ‘চিরতরে’ সবকিছু করার ধারণাকে আঁকড়ে ধরে আছে, গাজা যুদ্ধের পর তাদের তো বেকুব বনে যাওয়ার কথা। এ যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের সব সমস্যার চিরতরে সমাধান ঘটার কথা ছিল। বাস্তবে এক বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, তীব্র লড়াই, হাজার হাজার প্রাণহানি আর পুরোপুরি ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও আমাদের কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং যতটা খারাপ অবস্থায় ইসরায়েল এই যুদ্ধে নেমেছিল, যুদ্ধ শেষে তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় দাঁড়াবে।
তাহলে কীভাবে কেউ চিন্তা করতে পারে যে অধিকতর শক্তিশালী একটি শত্রুর সঙ্গে অধিকতর প্রতিকূল ভূমিতে লড়তে গিয়ে সারা দুনিয়ার কাছ থেকে নিন্দা কুড়ানো শ্রান্ত এক সেনাবাহিনী গাজায় বিপর্যয়ের পর তার চেয়ে ভালো ফল বয়ে আনবে? বরং এমন চিন্তার মানেই হলো, বেশির ভাগ ইসরায়েলি গাজায় ব্যর্থতাকে আত্মস্থ করতে পারেনি। তারা এখনো এটা চিন্তাই করতে পারছে না যে সিডনের (ভূমধ্যসাগরের কোলঘেঁষা লেবাননের তৃতীয় বৃহত্তম শহর) দিকে দ্রুত ছুটে যাওয়ার চেয়ে বরং আর কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়াই ইসরায়েলের জন্য ভালো হবে। রাফায় যে রকম ঘটেছিল, সে রকম না হওয়া। (ইসরায়েলজুড়ে) প্রতিবাদ হচ্ছে, তবে তা যুদ্ধের বিরুদ্ধে নয়।
যেখানে একদল সেনা অর্থহীন ও লক্ষ্যহীনভাবে নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে, নিজেরাও নিহত হচ্ছে, গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানে অন্য দলের সেনারা উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে আরেকটি দুর্ভাগা যুদ্ধের জন্য এবং সেটাও সেসব সমস্যা চিরতরে নির্মূল করার জন্য। এ রকম একটি পরিস্থিতি চিন্তা করতেই মাথা ঘুরে যায়। অথচ সবাই উচ্চ স্বরে এসব নিয়ে শুনছে ও মিথ্যা গিলছে। আর লেবাননের পর আমরা ইরানকে দেখে নেব। সেখানেও আমাদের জন্য সুযোগ আসবে। আর তা আমাদের সমস্ত সমস্যা চিরতরে দূর করার!
গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক। হারেৎজে প্রকাশিত লেখা ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া