দেশজুড়ে এ মুহূর্তে যে অবস্থা চলছে, তাতে এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। একটা নির্বাচন সামনে, যে নির্বাচন আমরা নিজেদের ভালোটা চাইলে প্রকৃত উৎসবমুখর হতো, অবরোধ-হরতাল থাকত না, হানাহানি ও সংঘাতের পরিবর্তে থাকত সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য এবং মানুষ মুক্তভাবে ভোট দিয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিতে পারত।
দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ক্রমেই এবং দৃশ্যমানভাবেই পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন এক অনমনীয় অবস্থানে চলে যাচ্ছে যে তাদের মধ্যে সংলাপ দূরে থাকুক, সৌজন্য বিনিময়ও যেন আর সম্ভব নয়। তাদের ভেতর আদর্শগতভাবে বিস্তর পার্থক্য, সেটি আমরা জানি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে আদর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল, সেই আদর্শের প্রশ্নে বা সার্বিকভাবে, মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত এবং নব্য উপনিবেশী পাকিস্তানি শাসনের আড়াই দশকের রাজনীতি, সংগ্রাম ও তার নেতৃত্ব এবং একাত্তরের যুদ্ধ ও বিজয়ের প্রশ্নেও দুটি দলের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।
তারপরও স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর এই মতপার্থক্য সত্ত্বেও কোনো সংলাপ সম্ভব হবে না, এ চিন্তা আমাদের ভাবিত করে। সংলাপটি অনেক আগেই শুরু হতে পারত, যখন আশির দশকের স্বৈরশাসন শেষে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের একটা সুযোগ আমরা পেলাম। তাহলে নিশ্চয় অনেক প্রশ্নের নিষ্পত্তি হতো, দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হতো এবং রাজনীতি স্বস্তিকর হতো। সেই সুযোগ এখনো যে নেই তা নয়, কিন্তু একটি জলনিরোধক প্রকোষ্ঠে রাজনীতি আটকে গেলে এঘর থেকে ওঘরে জল গড়াবে কীভাবে?
আমরা স্পষ্টতই নিজেদের ভালোটা চাই না, তা না হলে বাস্তবে নেহাত অপছন্দের প্রতিবেশীকেও সহ্য করতে পারলে, তার সঙ্গে সৌজন্য বজায় রেখে চলতে পারলেও রাজনীতির প্রতিবেশীকে কেন সহ্য করতে পারি না? যদি একটি পাড়ায় বারো মতের মানুষ পাশাপাশি থাকলেও সেটি রণক্ষেত্র হয় না, বরং মোটামুটি নিস্তরঙ্গই থাকে, তাহলে রাজনীতির পাড়ায় কেন এত উত্তাপ?
আমরা গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেছিলাম বটে, কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তন যে গণতান্ত্রিক চর্চার দুয়ার উন্মুক্ত করেনি, মাত্র দেড় দশকের মাথায় সেনাসমর্থিত সরকারের শাসনের প্রত্যাবর্তন তাই বুঝিয়ে দিয়েছিল।
২০১৮ সালের জুলাই-আগস্টজুড়ে কিছু স্কুলের ছাত্রছাত্রী যে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন করেছিল, যাতে ব্যানার টেনে তারা দাবি তুলেছিল ‘রাষ্ট্রের মেরামত চাই,’ সে রকম যদি ওই দুই বছরের সামরিক শাসনের পর দুটি বড় দল ‘গণতন্ত্রের মেরামত চাই’ ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় বসত, হয়তো দুই দলের মতপার্থক্য অনেকটাই ঘুচত। নির্বাচন সুন্দর হতো। জাতীয় সংসদ প্রাণবন্ত হতো। রাষ্ট্রের নানা মেরামতির কাজও নিষ্পন্ন হতো। সামনে নির্বাচন, অথচ পথেঘাটে সংঘাত, গাড়ি পুড়ছে, মানুষও পুড়ছে, জেল ভরে যাচ্ছে বিরোধী রাজনীতিবিদ ও কর্মী দিয়ে।
সেদিন এক কাগজে দেখলাম, বাবা কারাগারে, তাঁর ছোট্ট মেয়েটি কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে। ওই মেয়েটির কাছে রাজনীতির কোনো অর্থ নেই। তার কাছে বাবার সান্নিধ্যটাই মূল্যবান। শুধু রাজনীতির কারণে কেন পরিবারগুলোয় এত বিপর্যয় নেমে আসবে? এর আগে এ রকম আরেকটা বিপন্ন মেয়ের কান্নাভেজা চোখের ছবি দেখেছিলাম। মেয়েটির কান্না অবশ্য আর কোনো দিন ফুরাবে না।
তার বাবা ছিলেন একজন পোশাককর্মী। বাড়ি ফেরার সময় কোনো কারণ ছাড়াই তাঁকে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। মেয়েটি বসে ছিল তার বাবার মৃতদেহের পাশে। তার চোখে যে শূন্যতা, সেটি পূর্ণ করতে পারে তেমন কোনো রাজনীতি নেই, তেমন কোনো রাষ্ট্রও জন্মায়নি।
আমরা নিজেদের ভালোটা চাইলে মেয়েটিকে এবং তাদের মতো অসংখ্য সন্তানকে শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়া থেকে আগলে রাখতে পারতাম। ভালোটা চাইলে গণতন্ত্রকে জাতিগঠনের প্রধান শক্তি হিসেবে আমরা তৈরি করতাম, ভিন্নমতকে স্বাগত জানাতাম, শত্রুতার পরিবর্তে তাকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং আমাদের নানা মত ও পথকে ত্রুটিমুক্ত করতে কাজে লাগাতাম; মনের জানালাগুলো আরও অবারিত করে যে চিন্তা, তাকে আবদ্ধ করা থেকে দূরে থাকতাম।
সেই সুযোগ যে ফুরিয়ে গেছে, তা নয়। উদ্যোগটা যেকোনো সময় শুরু করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন নিজেদের ভালো করাটা এখন যে কত জরুরি, কতটা অনিবার্য; সেই বার্তাটা একে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই পৌঁছে দেওয়ার কাজ অন্যরাও করতে পারেন, সেই রকম মানুষ এই সমাজে আছেন।
দেশের সংকট যত গভীর হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই সংকট রাজনীতির অঞ্চল ছাড়িয়ে অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগ, পোশাক রপ্তানি, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভসহ নানা ক্ষেত্রে যে ছড়িয়ে যাবে, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা একবাক্যেই বলছেন। আমি নিশ্চিত, দুটি দলও নিশ্চয় বার্তাটির গুরুত্ব বোঝে।
নিজের ভালো করতে না চাওয়ার প্রসঙ্গে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখা আত্মঘাতী বাঙালী গ্রন্থটির কথা মনে পড়ল। তাতে মানবজীবন ও সভ্যতার ক্ষয় প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বাঙালী জীবনের শ্রান্তি ও অবসাদ ১৯২২-২৩ সন হইতে অনুভব করিতে আরম্ভ করি।’ এই অবসাদ জীবনশক্তির বিপরীত, যা বাঙালির নিজেরই কর্মফল।
আমার ভাবতে ইচ্ছা হয়, আমরাও কি স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ দশক পর আমাদের জীবনে একটা অবসাদ দেখতে পাচ্ছি? আমরাও কি আত্মঘাতী? আত্মঘাতী, অর্থাৎ আমাদের বিশাল সব সম্ভাবনাগুলো কাজে না লাগিয়ে শুধু স্বার্থচিন্তা, গোষ্ঠীবিবাদ আর পরস্পরের অনিষ্ট সাধনে ব্যস্ত। আমাদের রাজনীতিও কি সেই স্বার্থচিন্তা আর গোষ্ঠীবিবাদে পুষ্ট নয়?
রাজনীতিকে আমরা সামষ্টিক মতবিনিময়, দেশের মঙ্গলের জন্য সর্বোচ্চ কার্যক্রম ও প্রণালি নির্ধারণ, মানুষের অধিকার রক্ষা, বৈষম্য দূর করা, প্রত্যেকের জীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলো জ্বালা এবং প্রতিটি রাজনৈতিক-সামাজিক-ঐতিহাসিক উপলক্ষকে উদ্যাপনের বিষয় হিসেবে সাজিয়ে নেওয়ার একটা উপায়ে পরিণত করার পরিবর্তে করেছি সংঘাতের একটা ক্ষেত্র। সংঘাত তো কোনো সমাধান দেয় না, দেয় আরও ব্যাপক এবং ভয়াবহ সংঘাতের আশকারা।
আমাদের একটা মূল সমস্যা হচ্ছে, সংঘাত-সংঘর্ষের ভেতর থেকে আমরা প্রকৃত শত্রুকে ভুলে গেছি। আমাদের শত্রু দারিদ্র্য, সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য এবং যারা তা উৎপাদন করে তারা।
বৃহৎ পুঁজির ও বাজারের শাসন আমাদের শত্রু, ভূরাজনীতির নানা কূটচাল আমাদের শত্রু, সাম্প্রদায়িকতা আমাদের শত্রু। সেগুলো মোকাবিলায় আমাদের কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা শত্রু ভাবি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, তত শত্রু শত্রু হুংকার প্রবল হচ্ছে। অথচ প্রকৃত শত্রুগুলো আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
সিলেট অঞ্চলের পুরোনো এক লোককথায় আছে, দুশমন যদি খুঁজতে যাও, নিজের ছায়ার দিকে প্রথমে তাকাও। ভুল পক্ষকে শত্রু ভাবলে আমার যে ক্ষতি হবে, তার জন্য নিজেকেই তো দায়ী করতে হবে। সেই দায় যে সৃষ্টি করে, সে লুকিয়ে থাকে আমারই ভেতর।
ভাটির এক দার্শনিকের কী চমৎকার অনুধাবন।
নীরদ চৌধুরীর সঙ্গে দুই সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম অক্সফোর্ডে। তাঁর সম্পর্কে একটি লেখায় আমি এমনও দেখেছিলাম, তিনি বাঙালির শত্রু। ছোটখাটো মানুষটিকে দেখে প্রশ্ন জেগেছিল, কথাটা কি ঠিক? দ্বিতীয় দিন তিনি আত্মঘাতী বাঙালী বইটিতে কয়েক ছত্র কথা লিখে আমাকে দিয়েছিলেন, ‘আজ আবার দেখলাম আমি আর এক অজানাকে জানলাম, ও আর একটি ঘরে ঠাঁই পেলাম।’
মাত্র দুই সন্ধ্যার কথাবার্তায় কতটুকু আর জানা যায়। কিন্তু এই বাঙালি-নিন্দুক বলে কথিত মানুষটি কত সহজে আমার ঘরে ঠাঁই খুঁজে নিলেন। বাঙালিকে আত্মঘাতী বলা কি শত্রুতা, না সত্য কথাটা অকপটে বলা? আমরা যে আত্মঘাতের পথে নেমেছি, কথাটা কি ভুল? তবে নীরদ চৌধুরীর বইয়ের শিরোনাম শেষ কথা বলে না। তিনি নিজেও লিখেছেন, বাঙালিকে নিয়ে তাঁর আশাবাদ মিলিয়ে যায়নি।
আমাদের আশাবাদও জাগরূক।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ