জাতীয় নির্বাচন: ন্যাড়া বেলতলায় কতবার যাবে

আমেরিকান সংবাদপত্র দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট তার ১৪০ বছরের ইতিহাসে ২০১৭ সালে প্রথম ‘ডেমোক্রেসি ডাইস ইন ডার্কনেস’ অফিশিয়াল স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করে এবং সংবাদপত্রটির ওয়েবসাইটে স্লোগানটি চালু করে। ঠিক বছর পেরোতেই প্রায় আট হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার অভিযোগ আসে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই নির্বাচনের ৫০টি আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই অনিয়মের প্রমাণ পায় এবং এই নির্বাচন  ‘প্রশ্নবিদ্ধ’, ‘অভূতপূর্ব’, ‘অবিশ্বাস্য’ বলে প্রতিক্রিয়া জানায়।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেওয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি। কী বলব এটা হয়। এটা হয় না, ঠিক না।’ ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ইসি মাহবুব তালুকদার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘দিনের ভোট রাতে করে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ।’ ২০২২ সালের মে মাসে এক মতবিনিময় সভায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট দিনেই হবে। রাতে কোনো ভোট হবে না।’ এটি বলে তিনিও পক্ষান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন দিনের ভোট রাতে হয়েছে।

সম্প্রতি একজন সংসদ সদস্যের উদ্দেশে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘রাতের অন্ধকারে এমপি হয়েছ, আমরাই তো তৈরি করেছি।’ উনিই প্রথম নন ‘রাতের ভোট’ বলে সরল স্বীকারোক্তি দেওয়ার তালিকায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাসহ আরও অনেক সরকারদলীয় নেতা আছেন।  

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ২০২৩ সালের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে ‘গণতান্ত্রিক’ কিংবা ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। দেশটির নাম আছে স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝামাঝি ‘হাইব্রিড রেজিম’ তালিকায়। যার অর্থ এখানে যথেষ্ট অনিয়ম রয়েছে, যা নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু হতে বাধা দেয়, ব্যাপক দুর্নীতি এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগ হয়।

উইনস্টন চার্চিল গণতন্ত্রে নির্বাচনের তাৎপর্য এবং ভোটারদের ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে একটি সুন্দর মন্তব্য করেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতি সব শ্রদ্ধার মূলে সেই ছোট্ট মানুষটি, একটি ছোট্ট বুথে হাঁটা, একটি ছোট্ট পেনসিল দিয়ে, সামান্য কাগজের ওপর একটি ছোট ক্রস তৈরি করা—কোনো অলংকার বা উপমা দিয়ে বা বিশাল আলোচনা করে এর অপ্রতিরোধ্য গুরুত্বকে কমানো যায় না।’ গণতন্ত্রে প্রকৃত ক্ষমতাবান চার্চিলের এই ‘ছোট্ট মানুষগুলো’ বাংলাদেশে আজ উপেক্ষিত, অধিকারবঞ্চিত। ছোট্ট মানুষটি সামান্য কাগজে তার ছোট্ট ক্রস তৈরি করার জন্য ছোট্ট পেনসিল নিয়ে ছোট্ট বুথে যেতে পারে না।

দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সার্বিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকারিতা এবং বৈষম্য দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং বিগত যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে, জনগণের সম্পদ চুরি করে বিদেশে পাচার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ব্যাপক এবং গভীর। ক্ষমতা আরও বেশি কুক্ষিগত হয়েছে। পুলিশ, প্রশাসন ক্রমাগত সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েছে।

গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। সারা দেশে যে অন্যায় পরিস্থিতি, যে অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তার নিরসন ঘটাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এ ক্ষেত্রে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য, ‘আপনি যদি অন্যায়ের পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ হন, তবে আপনি নিপীড়কের পক্ষ বেছে নিয়েছেন।’ এ দেশ আমাদের, এ স্বাধীনতা আমাদের, আমাদের গণতন্ত্র লুণ্ঠিত হয়েছে। এ দায় শুধু কোনো রাজনৈতিক দলের একার নয়, এই দায় সব নাগরিকেরও।

বেশি দিন ক্ষমতায় থাকায় শাসকদের আরও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে বাক্‌স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়েছে। খুন, গুম, মামলা, হয়রানি, নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিস্তৃত হয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়েছে। ২০২২ সালে প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬২তম, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন স্কোর।

সবকিছু ছাপিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যখন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর বিরোধী দলগুলো ও সাধারণ জনগণের আস্থার ঘাটতি চরমে। প্রার্থীর মুখে এখন শোনা যায়, ‘শেখ হাসিনা নৌকা দিছে, আবার ইলেকশন কিসের? আর ইলেকশন যদি হয়, বুঝে নেবেন ইলেকশন কাহাকে বলে।’

একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একটি নির্বাচনী সভায় উপজেলা  চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি আটটি কেন্দ্রে কারচুপি ও ভোট ডাকাতি করেছিলাম। তা না করলে আপনি উপজেলা চেয়ারম্যান হতে পারতেন না।’ নির্বাচন কমিশন অনেকটাই এখন ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা নিয়েছে। একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করতে যাকে খুশি নিবন্ধন দিচ্ছে, অপছন্দের প্রার্থীর নমিনেশন বাতিল করছে। উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের মুখে প্রার্থীর ওপর হামলা নিয়ে তাঁরা নির্বিকার থাকছে।

এ যদি হয় চিত্র, তাহলে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কী না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সরকার বলেছিল এটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে একটা সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের অঙ্গীকারও করা হয়েছিল তখন। কিন্তু সেটি হয়ে যায় কথার কথা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকার সংলাপে বসেছিলেন কিন্তু ‘বিচার মানি, তবে তালগাছ আমার’ মার্কা সংলাপের পরিণতি জাতি দেখেছে। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া আর ন্যাড়ার বারবার বেলতলায় যাওয়া একই।

মোদ্দা কথা, গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। সারা দেশে যে অন্যায় পরিস্থিতি, যে অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তার নিরসন ঘটাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এ ক্ষেত্রে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য, ‘আপনি যদি অন্যায়ের পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ হন, তবে আপনি নিপীড়কের পক্ষ বেছে নিয়েছেন।’ এ দেশ আমাদের, এ স্বাধীনতা আমাদের, আমাদের গণতন্ত্র লুণ্ঠিত হয়েছে। এ দায় শুধু কোনো রাজনৈতিক দলের একার নয়, এই দায় সব নাগরিকেরও।

  • ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক
    ই-মেইল: faridecoru@yahoo.co.uk