বৃহত্তর বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব নেবে কি ঢাকা?

এ-ও ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, দক্ষিণ এশিয়ার আরও বহু জায়গায় বাংলাভাষীরা ভাষা-অধিকার নিয়ে বিস্তর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বে বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। দু-তিন কোটি বাদে বাকি সবার নিত্যসময়ের ভাষা বাংলা। একুশে ফেব্রুয়ারি এ রকম সব বাংলাভাষীর কাছে বিশেষ মর্যাদার। ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক ওই মুহূর্তের ৭০ বছর পেরোল। মধ্যে স্বাধীন দেশও পেল বাংলাভাষীদের বড় অংশ। কিন্তু ঢাকা এই ভাষার সমগ্র মানুষের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভূমি হতে পারল কি না, সে বিষয়ে হয়তো এখন ভাবা যায়।

১৯৫২ নিয়ে শোক, উচ্ছ্বাস ও আগ্রহের মধ্যে বরাক বা মানভূমির ভাষাসংগ্রামীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটা ঠাঁই পাচ্ছে বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের ভূরাজনৈতিক বিবেচনায়? প্রশ্নটা এভাবেও তোলা যায়, ‘একুশ’ ঢাকার সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাভাষীদের অভিভাবকত্বের দায় তৈরি করছে কি না?

মানভূমি ও বরাকের বাংলাভাষীদের কথা

বাংলা ভাষার প্রসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব এবং অবদান অবশ্যই বিশাল। তবে এ-ও ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, দক্ষিণ এশিয়ার আরও বহু জায়গায় বাংলাভাষীরা ভাষা-অধিকার নিয়ে বিস্তর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়েছে। কেবল উর্দু নয়, কোথাও হিন্দি, কোথাও অসমিয়াভাষীদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় লিপ্ত হতে হয়েছে তাদের। নানান অঞ্চলে নানান আদলে সেই সংগ্রাম চলছে।

পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষীরা প্রায় ৮৬ ভাগ। ত্রিপুরায় ৭০ ভাগ। আসামে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ঢাকা, কলকাতা, আগরতলা, আসাম মিলে ‘বাংলা’র জগৎটা বেশ বড়। কিন্তু ঢাকার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিসীমা ততটা প্রসারিত হলো কই? বিশেষ করে মানভূমির দীর্ঘস্থায়ী ভাষা আন্দোলন এবং বরাকের ব্যাপক রক্তদান বাংলাদেশে আজও প্রয়োজনীয় মনোযোগ পেয়েছে বলে মনে হয় না।

সে রকম মনোযোগ পেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনার মানুষ নিশ্চয়ই ফেব্রুয়ারিতে বাংলার জন্য বিহারের টুসু সত্যাগ্রহীদের স্মরণ করত। ভজহরি মাহাতোকেও ঢাকার মানুষেরা চিনত—যিনি দিল্লিতে লোকসভা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন ‘প্রান্তিক’ বাংলাভাষীদের রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নকে। একুশের চৈতন্যকে ঢাকার চৌহদ্দির বাইরে খুঁজতে গেলেই আমরা ‘লোকসেবক সংঘ’ নামে অসাধারণ এক ভাষাসাধনারও দেখা পেতাম; বাংলাভাষী হয়েও ঝাড়খন্ডের কাছে বাংলাভাষী দানবাদ অঞ্চল হারানোর ব্যর্থতা শনাক্ত করতে পারতাম। এ-ও জানতাম, পূর্ব ঝাড়খন্ডের প্রায় ৩৩ লাখ বাঙালি বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য এ মুহূর্তে লড়ছে।

পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বাংলাভাষীরা যখন হিন্দির সঙ্গে অসমযুদ্ধে লড়ছে, বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের হিন্দিপ্রীতি তাদের বিস্মিত করে তখন। একইভাবে পূর্ব ঝাড়খন্ড কিংবা বিহারের মুঙ্গেরের বাংলাভাষীরা চায়, ঢাকার একুশ তাদের কথাও ভাবুক। কিন্তু যোগাযোগটা পারস্পরিক হয়ে উঠছে না

হিন্দির বহু আগে থেকে এখানে মানুষ বাংলায় কথা বলে। রাজ্যের নাগরিকদের বড় একাংশ তাঁরা। সরকার বলে ১০ ভাগ, তাঁরা বলেন আরও বেশি। রাজ্যের ৪২ ভাগ নাগরিক তারা। একুশ তাদের উদ্দীপনা দেয়। কিন্তু বাংলা পাঠ্যবই ও শিক্ষকসংকটের মধ্যে ‘দাপ্তরিক ভাষা’ হিন্দিতে কাজ চালাতে বাধ্য হচ্ছে তারা। স্থানীয় বাংলাভাষী স্কুলগুলো অন্য জায়গার বাংলাভাষী বুদ্ধিজীবীদের কারিগরি সহায়তা পেলে আরও ভালো চলত। কিন্তু কে করবে, সে সহযোগিতা? বাংলা নিয়ে লড়তে লড়তে মানভূমিরই একাংশ ১৯৫৬ থেকে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া হলো। কিন্তু বাংলাদেশ কলকাতাকে যতটা চিনল-জানল, পুরুলিয়ার কাছে ততটা পৌঁছায়নি।

হিন্দিতে ঢাকার আগ্রহ দেখে বিস্মিত হয় দূরের বাংলাভাষীরা

কেবল প্রান্তিক পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড নয়, বিহার ও আসামের বাংলাভাষীদের কাছেও এটা বেশ অদ্ভুত ঠেকে, ঢাকার রাজনীতি আঞ্চলিক সব বিষয় কেবল নয়াদিল্লির সঙ্গে রফা করতে চেয়েছে গত পাঁচ দশক। তার কাছে দূরে থেকেছে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষীদের জানাশোনার ব্যাপারও। সহিংসতা ও এনআরসির ভীতির মধ্যেই আসামে আজও প্রায় ৩০ ভাগ মানুষের ঘরের ভাষা বাংলা। ১৮৩৬ থেকে প্রায় ৪০ বছর আসামে বাংলা দাপ্তরিক ভাষা ছিল।

সেই মর্যাদা বাতিল শেষে যখন সর্বত্র অন্ধভাবে অসমিয়ার আধিপত্য বাড়ানো শুরু হলো, তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়েই ১৯৬১-এর মে মাসে শিলচরে ১১ জন বাংলাভাষী নর-নারী জীবন দিয়েছিলেন। বরাকের ওই প্রতিবাদীদের কাছে সেদিন বড় প্রেরণা ছিল একুশে।

মাওলানা ভাসানী চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও ভুলে গেল সেখানকার দুই ভ্যালির ওই বাংলাভাষীদের কথা। আজ ট্রানজিট, করিডর, অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে ঢাকার যত কথা হয়, সবই নয়াদিল্লির সঙ্গে। বরাক কিংবা গোয়ালপাড়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, সহযোগিতা, যোগাযোগ দীর্ঘ মেয়াদে কিছু দাঁড়ায়নি। আগরতলার সঙ্গেও অল্পবিস্তর একই অবস্থা।

ঢাকা থেকে অনেকে কলকাতা বইমেলায় যান, কিন্তু সেখানে যে বিহারের বাংলাভাষীদের চমৎকার স্টল ছিল, তাদের ঢাকায় আনার চেষ্টা হয়নি। প্রতি রোকেয়া দিবসে পশ্চিমবঙ্গে যে ‘জাতীয় বাংলা সম্মেলন’ হচ্ছে, সে খবরও ঢাকার পত্রপত্রিকায় আসে না।

বাংলাভাষী গোয়ালপাড়া যে একদা আরেক বাংলাভাষী রংপুরের অংশ ছিল কিংবা বরাক যে একদা পূর্ব বাংলা-আসাম প্রদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, সে-ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কম লোকই হৃদয়ের দরদ দিয়ে ভাবার সময় পান। সাংস্কৃতিক মৈত্রীর ঐতিহাসিক সূত্র সন্ধানের কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল এবং সুযোগও ঘটেছিল স্বাধীন দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের। তাঁদের উদাসীনতার দূরবর্তী ফল এ-ও যে ত্রিপুরা ও আসামে বাংলাভাষীরা বর্ণবাদী ‘বিদেশি’ তকমায় অপমানে ভোগে, মার খায়। করাচিতে ২০ লাখ বাংলাভাষী সেখানকার নাগরিকত্ব পেতে যে দশকের পর দশক আহাজারি করছে, তা–ও অজানা। জানাবোঝার এই ঘাটতি হতাশা ও দূরত্ব বাড়ায় বৈকি।

পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বাংলাভাষীরা যখন হিন্দির সঙ্গে অসমযুদ্ধে লড়ছে, বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের হিন্দিপ্রীতি তাদের বিস্মিত করে তখন। একইভাবে পূর্ব ঝাড়খন্ড কিংবা বিহারের মুঙ্গেরের বাংলাভাষীরা চায়, ঢাকার একুশ তাদের কথাও ভাবুক। কিন্তু যোগাযোগটা পারস্পরিক হয়ে উঠছে না।

ভারতজুড়ে প্রায় আট ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে। ঢাকা হাত বাড়ালে তারাসহ বাংলাভাষীদের বৃহৎ এক সাংস্কৃতিক পরিসর গড়ে উঠতে পারে। একুশের চেতনা তখন ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে এসে নতুন তাৎপর্যে হাজির হতো। তার জন্য হয়তো একুশের ভেতর থেকে নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উত্থান জরুরি ছিল।

কেবল সে রকম নেতৃত্বই মুদ্রিত ইতিহাসের আবেগ ও সীমান্ত থেকে একুশকে নতুন পরিসরে নিয়ে যেতে পারত। ভাষাসংগ্রামের গৌরব যার মধ্যে বৃহত্তর এক বৈশ্বিক জ্ঞানসমাজ গঠনের তাগিদ তৈরি করত, যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানও আরও দৃঢ়তা পেত।

ঢাকা হয়ে উঠতে পারত তখন ৩০ কোটি মুখের কল্লোলিনী এক ভাষার সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, যার সঙ্গে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সহবাসী হতে পারে পুরো অঞ্চলের অন্য ভাষাভাষী ভূমিজরাও। বাংলাদেশ কবে তার ইতিহাসের ভেতর থেকে সেই সম্ভাবনা নিয়ে জেগে উঠবে? আর কবে?

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক