মতামত

পাকিস্তানে রাজনৈতিক ঝড় ও ইমরানের ‘বাংলাদেশ দর্শন’

ইমরান খান পাকিস্তানের প্রথম সামনের সারির রাজনীতিক, যিনি একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন চালানোর কথা স্বীকার করলেন
ছবি: এএফপি

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁর দেশের বর্তমান অবস্থাকে একাত্তরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পাকিস্তানের রাজনীতি এতই অনিশ্চিত ও অস্থির যে আজ যিনি ক্ষমতায়, অদৃশ্য হাতের ইশারায় কাল তাঁর স্থান হয় জেলখানায়।

২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলায় তাঁর কপাল পুড়ল। তিনি যেসব ছোট দলের সঙ্গে জোট করেছিলেন, অদৃশ্য হাতের ইশারায় তারা তাঁকে ছেড়ে মুসলিম লীগ-পিপিপি জোটে ভিড়ে গেল। অনাস্থা ভোটে হেরে গেলেন ইমরান।

৭৫ বছর বয়সী পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এতই প্রবল যে, কোনো প্রধানমন্ত্রীই মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে ইমরান খান লাহোরে তাঁর বাসভবনের সামনে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে অতীতের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী রায় বানচাল করার কারণেই পাকিস্তান ভেঙেছে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) গণহত্যা চালিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ক্রিকেটার। তাঁর হাত ধরেই পাকিস্তান ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল।

অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট খেলায় অংশ নিতে ইমরান ১৯৭১ সালে ঢাকায় আসেন। ১ মার্চ যখন ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা চলছিল, তখনই খবর আসে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। তাঁর এই ঘোষণায় পুরো ঢাকা ফুঁসে ওঠে। সে সময় ঢাকায় তাঁর অভিজ্ঞতার কিছু বর্ণনা আছে ইমরানের আত্মজীবনীমূলক বই ‘পাকিস্তান: দ্য পারসোনাল হিস্ট্রি’তে।

ইমরান লেখেন, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলছিলাম। আমাদের কাছে সবকিছু শত্রুভাবাপন্ন মনে হয়েছিল। শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শক, এমনকি প্রতিপক্ষ পূর্ব পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দেরও।’

সেদিন তরুণ ইমরান তাঁর ভাষায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানিদের ক্ষোভের কারণ জানতে না পারলেও আজ উপলব্ধি করছেন।

ইমরান খান একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের ৯০ হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করেছেন, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার-নির্যাতন যেমন কাজে আসেনি, তেমনি এখন তারা যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, তা-ও কাজে লাগবে না।’ তাঁর ভাষায়, ‘আজ গণতন্ত্র সুতার ওপর ঝুলছে। বিচার বিভাগই একে রক্ষা করতে পারে। এই মাফিয়ারা (মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি লক্ষ করে) বিচার বিভাগকে আক্রমণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।’

৯ মে ইমরান খান ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে একটি মামলায় হাজিরা দিতে গেলে পাঞ্জাব রেঞ্জারসের সদস্যরা তাঁকে কমান্ডো কায়দায় গ্রেপ্তার করেন। তিনি একে বলেছেন ‘অপহরণ’। ইমরান মুক্তি পাওয়ার পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা আদালতের সামনে বিক্ষোভ করেন। মুসলিম লীগের নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়ে মরিয়ম শরিফ বলেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির উচিত পিটিআইতে যোগ দেওয়া।

ইমরান বলেছেন, ক্ষমতার প্রতি লোভের কারণেই একজন ধূর্ত রাজনীতিক বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন। পিটিআইকে বৃহত্তম ও একমাত্র ফেডারেল পার্টি হিসেবে দাবি করেন তিনি। ইমরান বলেন, একাত্তরে ভুট্টো যেভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন, বর্তমানে একইভাবে নওয়াজ ও আসিফ জারদারি পিটিআইকে ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা করছেন সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে।

তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্র ভঙ্গুর, সেসব দেশে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে কখনো সুনজরে দেখে না। আজ ইমরান সুপ্রিম কোর্টের ভূয়সী প্রশংসা করলেও গত এপ্রিলে তিনি ক্ষমতা বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইমরান খান নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। যদিও নির্বাচন কমিশন তাঁর সদস্যপদ বাতিলের পাশাপাশি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখন ঝড় বইছে। একদিকে ইমরান খান, অন্যদিকে শেহবাজের নেতৃত্বাধীন সরকার ও সেনা নেতৃত্ব। গত বছর নভেম্বরে পিটিআইয়ের সমাবেশে হামলা হলে ইমরান গুলিবিদ্ধ হন। এই হামলার জন্য ইমরান প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইএসআইপ্রধানকে দায়ী করেন। যদিও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁর সে দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়।

পাকিস্তানের নির্বাচনের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। পিটিআইয়ের নেতারা অবিলম্বে নির্বাচন দেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। দেশের বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল অনেক আগেই। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল নিয়ে টালবাহানা করলে পিটিআই আবার আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালত ১৪ মের মধ্যে নির্বাচন করার নির্দেশ দিলেও সরকার আর্থিক অসচ্ছলতার দোহাই দিয়ে নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকে। আগামী আগস্টে জাতীয় পরিষদের মেয়াদ শেষ হবে। সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন করার কথা। পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু আছে, যদিও প্রতিটি নির্বাচনেই সেনাবাহিনীই কলকাঠি নাড়ে।

আবার একাত্তরে ফিরে যাই। ইমরান বলেছেন, ক্ষমতার প্রতি লোভের কারণেই একজন ধূর্ত রাজনীতিক বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন। পিটিআইকে বৃহত্তম ও একমাত্র ফেডারেল পার্টি হিসেবে দাবি করেন তিনি। ইমরান বলেন, একাত্তরে ভুট্টো যেভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন, বর্তমানে একইভাবে নওয়াজ ও আসিফ জারদারি পিটিআইকে ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা করছেন সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে।

অভিযোগ আছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খানের ক্ষমতায় আরোহণের পেছনে সেনাবাহিনীর সহায়তা ছিল।

ইমরান খান পাকিস্তানের প্রথম সামনের সারির রাজনীতিক, যিনি একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন চালানোর কথা স্বীকার করলেন। তবে ২০১৫ সালে যখন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তখন ইমরান প্রতিবাদ করেছিলেন। তাহলে কি গণহত্যার বিষয়টি তিনি তখন জানতেন না?

একাত্তর নিয়ে পাকিস্তানি রাজনীতিকেরা যে স্ববিরোধিতা ও কপটতায় ভুগছেন, তা থেকে ইমরান খানও নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    sohrabhassan55@gmail.com