১৭৭৬ সালে আমেরিকা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। সেটি ছিল আমেরিকার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
১৮৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে দাঙ্গায় ছয় লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। গৃহযুদ্ধ শেষে দাসপ্রথার অবসান হলো। তবে পরবর্তী কয়েক দশকে বর্ণবাদী শক্তিগুলো আবার ক্ষমতায় ফিরে এল এবং পুরোনো কনফেডারেসিজুড়ে বর্ণবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করল। সেটিও ছিল আমেরিকার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিট ভেঙে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মহামন্দার মুখে পড়ল। সেটিও ছিল আমেরিকার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হারবারে হামলা চালানোর পর অপ্রস্তুত অবস্থায় থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপে হিটলার এবং এশিয়ায় জাপান—এই দুটি ফ্রন্টে সমানতালে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। তখন বিশ্বে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল। এটিও ছিল আমেরিকার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
আজ ২০২৪ সালে এসে আবারও আমেরিকার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হাজির হয়েছে। আমরা এখন এক বিশাল সংকটের মুখে পড়েছি। এই সংকট যদি মোকাবিলা না করতে পারি, তাহলে আমাদের ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে।
আজকের এই মুহূর্তে আমেরিকান জাতি উন্মাদের মতো অলিগার্কির (সম্পদশালীদের জন্য সব ধরনের ক্ষমতা সংরক্ষণ করা) দিকে ছুটছে। শতকোটিপতির একটি ক্ষুদ্র বলয় গোটা জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে।
এখানে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। অন্যদিকে ৬০ শতাংশ আমেরিকানের জীবন টানাটানির মধ্য দিয়ে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সব সম্পদ দখল করে রাখা ১ শতাংশ লোকেরা এই সময়ের মতো এতটা ক্ষমতা কখনোই ভোগ করতে পারেনি।
আমাদের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিপর্যয়কর সিদ্ধান্তের সুবাদে এখানে শতকোটিপতিরা কোটি কোটি ডলার খরচ করে তাদের পছন্দমাফিক প্রার্থীদের হারাতে বা জেতাতে পারছে। ফলে প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনের ৯০ শতাংশ এবং সিনেট নির্বাচনের ৮০ শতাংশ সেই প্রার্থীর হাতের মুঠোয় থাকছে, যিনি সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে পারেন।
আমাদের গড় আয়ু এবং জন্মহার ক্রমে কমে আসছে। আমাদের প্রায় ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় অনেক বাড়ানোর পরও এখন আমেরিকানদের গড় আয়ু ৭৭.৫ বছর, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ১৮ মাস কম। অন্যদিকে গত বছর আমাদের মোট জন্ম ৩৫ লাখ ৯০ হাজারে নেমে এসেছে, যা এ পর্যন্ত রেকর্ড করা সর্বনিম্ন স্তর।
জলবায়ু সংকট এই গ্রহের ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ফেলেছে। গত ১০ বছরে উষ্ণতার দিক থেকে ১০টি নতুন রেকর্ড হয়েছে। ২০২৩ সাল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল। ২০২৪ সালে আরও বেশি উষ্ণ বছর হওয়ার পথে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন সামরিক খাতে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছে, যা তার পরের সারির অন্তত ১০টি দেশের মিলিত সামরিক ব্যয়ের চেয়ে বেশি। এই ব্যয় খাদ্য, আবাসন এবং শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা মোট ফেডারেল তহবিলের চেয়ে বেশি।
এর মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বর্তমানে গাজায় নেতানিয়াহুর ডানপন্থী চরমপন্থী ইসরায়েলি সরকারের দ্বারা পরিচালিত ভয়াবহ যুদ্ধের সমর্থনে ব্যয় করা হচ্ছে।
সুতরাং চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, আমরা আমেরিকার ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছি। এ অবস্থায় আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? বা কী হওয়া উচিত?
ইসরায়েলের বিষয়ে বাইডেনের অবস্থান নিয়ে যদি আপনার নেতিবাচক ধারণা থাকে, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে, এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান বাইডেনের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।
প্রথমত, আমরা যে বেদনাদায়ক ও জটিল বাস্তবতার মুখে পড়েছি, সেই বিষয় থেকে সরে এসে আমরা উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে থাকতে পারি না। আমরা কিছু না দেখার ভান করে খবর পড়া বন্ধ করতে পারি না কিংবা টিভি বন্ধ করে রাখতে পারি না।
বিশ্বে যা কিছু ঘটার, তা ঘটে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এখন যা অবস্থা, তাকে একেবারে গন্ডগোলের পরিস্থিতি বলা যায়। সবাই মিলে জোর চেষ্টা না করলে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের অবশ্যই ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ, এই নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের সবার জীবনযাপন ও ভালো থাকা মন্দ থাকার প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে।
হ্যাঁ, আমি জানি বাইডেন তেমন জনপ্রিয় নন এবং আমিসহ অনেক প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ ইসরায়েলের চলমান বিপর্যয়কর যুদ্ধ–সম্পর্কিত তার অনুসৃত নীতির সঙ্গে একেবারেই একমত নন।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, বাইডেন আসন্ন ভোটে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন না। তিনি যাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তিনি আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ট্রাম্প যদি পুনরায় নির্বাচিত হন, তাহলে তিনি আগের চেয়ে খারাপ আচরণ করবেন। সেই দিক তুলনা করে বলছি, বাইডেন যেকোনো বিবেচনায় ট্রাম্পের চেয়ে হাজার গুণ ভালো হবেন।
আপনি যদি জলবায়ু সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন, তাহলে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন নিয়ে আপনাকে দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যা আলোচনা হয়ে থাকে, সেটি একটি ‘ফালতু আলাপ’।
অন্যদিকে বাইডেন টেকসই জ্বালানি ও জ্বালানি দক্ষতায় ইতিহাসের যেকোনো প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে সহায়তা করেছেন।
ইসরায়েলের বিষয়ে বাইডেনের অবস্থান নিয়ে যদি আপনার নেতিবাচক ধারণা থাকে, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে, এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান বাইডেনের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।
বাইডেন একজন প্রথাগত আমেরিকান রাজনীতিবিদ, যিনি গণতন্ত্র, অবাধ নির্বাচন এবং ভিন্নমতের অধিকারে বিশ্বাস করেন। আর ট্রাম্প এর কোনোটাতেই বিশ্বাস করেন না। যাঁরা ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ করেছিলেন, সেই আট শতাধিক আক্রমণকারীকে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ক্ষমা করে দেবেন বলে ভাবছেন।
বার্নি স্যান্ডার্স যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা শ্রম ও পেনশন কমিটির চেয়ারম্যান
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ