ইসরায়েলে ইরান ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এ হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে বলেছেন, একটার পর একটা উত্তেজনা।
ইরানের এই হামলার বড় অংশটা ইসরায়েল তার মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম এবং যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের সাহায্যে ঠেকিয়ে দেয়। ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ইরান–সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করলে ইরান এই হামলা চালায়।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ হামলার কারণে প্রায় ৭০ হাজার বাসিন্দা তাদের বাড়িঘরছাড়া হয়েছে।
এক বছর আগে যে পরিস্থিতি ছিল, তার থেকে এখন মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা অনেক বেশি নাজুক। প্রাথমিকভাবে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যে সংঘাত শুরু হয়েছিল, এখন সেটা তার বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
এখন ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে এমন একটা সংঘাত শুরু হয়েছে, যেটা এক বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। আর এই সংঘাত হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাতের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল এই সংঘাতের কাজে তাদের স্পেশাল অপারেশন ইউনিটগুলো ব্যবহার করেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকেই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তারা লেবাননে গোপনে তাদের অভিযান পরিচালনা করেছে।
এ ছাড়া ইসরায়েল আরও কিছু অপ্রথাগত যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করেছে, যেগুলো যুদ্ধে ব্যবহার করার নজির নেই। এর মধ্যে পেজার ও ওয়াকিটকির নেটওয়ার্কে বিস্ফোরণের মতো ঘটনা রয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক সপ্তাহে তারা লেবাননে শত শতবার বিমান ও মিসাইল হামলা করেছে।
হিজবুল্লাহর নেতারা হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। বিমান হামলায় নিহত হওয়ার আগে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ বলেছিলেন, লেবাননে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ইসরায়েল ‘যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে’ এবং ‘শত্রু লাল রেখা অতিক্রম করেছে’।
ইসরায়েলের এই সম্মিলিত অভিযান হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডার, সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করেছে এবং হাসান নাসরুল্লাহসহ গোষ্ঠীটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা নিহত হয়েছেন।
এই হামলার মানবিক ক্ষয়ক্ষতিও অনেক। লেবাননের এক হাজারের বেশি মানুষ এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কতজন হিজবুল্লাহর সদস্য, সেটা জানা যায়নি।
ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বশেষ সরাসরি সংঘাত হয় ২০০৬ সালে। ৩৪ দিন স্থায়ী সেই সংঘাতে ১ হাজার ৫০০ জন লেবাননি ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধা নিহত হয়েছিলেন। এর পর থেকে দুই পক্ষ ছায়াযুদ্ধের মধ্যে থাকলেও ৭ অক্টোবরের পর যে মাত্রায় সংঘাত দেখা গেল, সেটা ছিল না।
এখন এই সংঘাত অঞ্চলের বাইরে বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার, এমনকি বৈশ্বিক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলো।
ইরান বলেছে, তারা ইসরায়েলে মিসাইল হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইরানের সামরিক বাহিনীর ওপর হামলার প্রতিশোধ হিসেবে। ইরান–সমর্থিত এই দল ও সংস্থাগুলোকে ইরান বলে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস করপসের জ্যেষ্ঠ কমান্ডাররা গাজা উপত্যকার হামাস, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া মিলিশিয়াদের উদ্দেশে একই নির্দেশিকা জারি করেছে।
৭ অক্টোবরের আগে এই গ্রুপগুলো মতাদর্শগতভাবে ইসরায়েলকে একমাত্রায় বিরোধিতা করত। কিন্তু তারা আবার নিজস্ব লড়াইয়ে যুক্ত ছিল। এখন তারা সবাই ইসরায়েলকে ধ্বংস করার একটা সাধারণ উদ্দেশ্য থেকে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব এবং ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান গঠনের পর থেকে ইরানের সঙ্গে হিজবুল্লাহ সম্পর্কটা গভীর। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল সীমান্ত পেরিয়ে আসা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন ও ফিলিস্তিনি অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ লেবাননে অভিযান চালিয়েছিল। সে সময়ে নবগঠিত আইআরজিসি লেবাননের গৃহযুদ্ধে লড়াইরত শিয়া মিলিশিয়াদের কাছে পরামর্শক ও প্রশিক্ষক পাঠিয়েছিল।
এটা স্পষ্ট যে লড়াইয়ে হিজবুল্লাহ তাদের যোদ্ধাদের হারাচ্ছে। কিন্তু হিজবুল্লাহ হামাসের চেয়ে অনেক বড় গোষ্ঠী এবং লেবাননজুড়ে অনেক বড় অঞ্চলজুড়ে ছড়ানো রয়েছে তাদের কর্মকাণ্ড।
হামাসের তুলনায় হিজবুল্লাহ কাছে অনেক উন্নত অস্ত্র রয়েছে। প্রথাগত সামরিক বাহিনীর কাঠামোর মধ্যে হিজবুল্লাহর ৪০ থেকে ৫০ হাজার নিয়মিত সেনা রয়েছে। তাদের ভান্ডারে স্বল্প, মধ্য ও দূরপাল্লার দেড় থেকে দুই লাখ মিসাইল, ড্রোন ও রকেট রয়েছে।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী মনে করছে, গত কয়েক সপ্তাহের অভিযানে তারা হিজবুল্লাহর ভান্ডারে থাকা অস্ত্রের অর্ধেকটা তারা ধ্বংস করতে পেরেছে। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে হিজবুল্লাহ এক দশক ধরে লড়াই করার যে সামর্থ্য তৈরি করেছে, তাতে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
গত ৪০ বছরে হিজবুল্লাহ যে মাত্রায় শক্তি প্রদর্শন করেছে এবং ইসরায়েল কীভাবে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আঘাত করেছে, সেই বিবেচনা থেকে এটা অনুমান করা কোনো দূরকল্পী কল্পনা হবে না যে ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে হিজবুল্লাহ যেমন তাদের প্রভাবাধীন অঞ্চলের বাইরে বেরিয়ে আর্জেন্টিনায় গিয়ে হামলা চালিয়েছিল, এখন সে ধরনের কোনো হামলা আর করবে না।
তবে হামলার মাত্রা কেমন হতে পারে, কোথায় সেই হামলা হতে পারে, তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা এখনই করা যাচ্ছে না।
হিজবুল্লাহর নেতারা হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। বিমান হামলায় নিহত হওয়ার আগে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ বলেছিলেন, লেবাননে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ইসরায়েল ‘যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে’ এবং ‘শত্রু লাল রেখা অতিক্রম করেছে’।
গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহ উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরও তাদের প্রতিরোধক্ষমতা টিকে রয়েছে। ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের জন্য হিজবুল্লাহর নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে কতটা দায়ী করবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
সেটা যদি হয়, তাহলে ১৯৮৯-এর দশকে হিজবুল্লাহ যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাপনার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়েছিল, আবার তারা সেটা শুরু করতে পারে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি তাতে বিশ্ব একটি বিপজ্জনক ও অস্থির নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
জাভেদ আলী, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জননীতি অনুশীলন বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত