শিশুর জন্ম দিতেও আমরা এখন ভয় পাচ্ছি

এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের অগ্রভাগে আছে শিশুরা
ছবি : প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পাঠ শেষ করার পরও একটা লিটলম্যাগ সূত্রে সেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আড্ডা জমত। টানা কয়েক বছর এই আড্ডা ছিল নিয়মিত। নিয়ম করেই লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিকেরা সেখানে আসতেন। এ রকমই এক আড্ডায় এক কবি একদিন বলে বসলেন, ‘আমি তো অন্য কারও কবিতা পড়ি না। কবিতা পড়লে সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়।’ এক দশক পর সেই কবি কোথায় আছেন, কী করছেন, এখন আর কবিতা লেখেন কি না, জানি না।  সেই কবির মতো আমাদের মেয়রেরা ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের কাজের সৃজনশীলতা নষ্ট হবে বলে সম্ভবত পত্রিকা পড়েন না কিংবা টেলিভিশনে খবর দেখেন না। ফেসবুক কিংবা টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাঁরা সম্ভবত ‘সৃজনশীল’ কোনো পথ অনুসরণ করেন।

না হলে গত মে মাস থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন মানবিক বিপর্যয়ের খবরে আমরা নাগরিকেরা যে ভয়, শঙ্কা ও আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়েছি, সেই খবর তাঁদের কাছে একটুও কেন পৌঁছাবে না? এ বছর ডেঙ্গু মহামারির মতো এক বিপর্যয় আর গণট্র্যাজেডির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃতদের মিছিলের অগ্রভাগে আমাদের হাসি-আনন্দ আর বেঁচে থাকার অফুরান ভান্ডার শিশুরা। একেকটা শিশুকে কেন্দ্র করে এই শহরে ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের একেকটা বাসায় একেকটা পরিবার যে সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না ও আনন্দের সংসার রচনা করে, সেই পরিবারগুলো তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে দুর্বিষহ, এর চেয়ে যন্ত্রণাময় বেঁচে থাকা আর কী হতে পারে!

মারা যাচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা, তাঁদের অনাগত শিশুরা। ভাবতে পারেন, এই শোকভার কীভাবে বইতে পারে একেকটা পরিবার? কয় দিন আগে একটা পরিবারে দুই যমজ শিশু মারা গেছে। সদ্য-সন্তান-হারানো এক মা প্রথম আলোর প্রতিবেদককে ফোন করে সেই মা-বাবাকে সমবেদনা জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার তো তা-ও সান্ত্বনা আছে। আমার একটি সন্তান বেঁচে আছে। তাঁদের সান্ত্বনা আর কোথায় থাকল?’
ডেঙ্গুর কারণে মানবিক বিপর্যয়ের এই অসহ দিনগুলোয় আমাদের কারও কি সান্ত্বনা আছে? এ বছরে সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিপরীতে উচ্চ মৃত্যুহারের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্ব রেকর্ড করেছে।

প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো জনবসতিপূর্ণ নগরগুলোর বাইরে গ্রামগুলোয় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত মানুষদের একটা অংশকে আইসিইউতে যেতে হচ্ছে। যমে-মানুষে টানাটানি শেষে অনেকেই ফিরছেন জীবনে। কিন্তু এই খরচ জোগাড় করতে গিয়ে সহায়সম্বল হারাতে হচ্ছে। অনেকে ধার করছে। অনেককে উচ্চ সুদে ঋণ করতে হচ্ছে। যে পরিবারে একাধিকজন গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। মহামারি আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির টানা ধাক্কায় জেরবার পরিবারগুলো ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ জোগাতে যারপরনাই অসহায় হয়ে পড়ছে। আইসিইউ যাদের লাগছে না কিংবা বাসায় যারা চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের অসহায়তাও কম নয়।

একদিকে মানুষের বিপর্যয় আর অন্যদিকে সংকটে মানুষকে জিম্মি করে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর বাড়তি মুনাফা করার সেই সুযোগসন্ধানী কৌশল। ফার্মেসিগুলো বলছে স্যালাইন নেই। স্বজনেরা ছুটছেন এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসিতে। কয়েক গুণ বেশি দাম দিলেই মিলছে। ডাব, মাল্টার মতো পথ্যের দাম সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হচ্ছে ইচ্ছেমতো। মশারি, মশার কয়েল, মশা নিরোধক ক্রিম, ইলেকট্রিক ব্যাটসহ মশা মারার সব পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে ইচ্ছেমতো।

সবার মধ্যেই আতঙ্ক, নিজেরা আক্রান্ত হলে কী হবে? কোথা থেকে চিকিৎসার খরচ জুটবে? বাবা-মায়েরা তাঁদের শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। কারও শিশুর জ্বর হলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চাইছেন, কী করবেন, কোথায় যাবেন? উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শিশুদের মধ্যেও। আমাদের এক সহকর্মীর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ভাতিজি ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হলে তার মধ্যে ধারণা জন্মে, সে মারা যাবে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে ফোন করে সে তার উদ্বেগ জানিয়ে ‘বিদায়’ নিতে শুরু করে। শিশুরা তাদের মা-বাবাকে বলতে শুরু করে দিয়েছে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে। আমাদের এক বন্ধু দম্পতি সন্তান নিতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে।

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সত্যিটা হলো, এই বিপর্যয়ের সময় অসহায় নাগরিকদের পাশে কেউ নেই। তাদের নিজেদেরই পুরো দুর্যোগ পার করতে হচ্ছে। এডিস মশা সাম্যবাদী হলেও ঘিঞ্জি এলাকাগুলোয় সংক্রমণের মাত্রা বেশি। এসব এলাকায় অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষদের বাস। হাসপাতাল আর চিকিৎসার যে ব্যয়, তা তাঁদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের নাম। এ কারণে চিকিৎসকদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন দেরিতে। চিকিৎসকেরাই বলছেন, ডেঙ্গুতে এত মানুষের মৃত্যুর মূল কারণই হলো দেরি করে চিকিৎসা নিতে আসা। কিন্তু এই দেরির পেছনে যে ভয়াবহ বৈষম্য আর অর্থনৈতিক সামর্থ্যহীনতা রয়েছে, সেটা কিন্তু কেউ বলছে না।

প্রশ্ন হলো, ৫২ বছর বয়সী একটি রাষ্ট্রের কি সামান্য এই মানবিক কাজের সক্ষমতা থাকবে না? স্রেফ দেরিতে হাসপাতালে পৌঁছানোর কারণে আমাদের শিশুরা যখন চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইউএনও-ডিসিদের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে একেকটা নতুন গাড়ি কেনার আয়োজন চলছে।

এবার ডেঙ্গু যে বিপর্যয় ঘটাবে, তার পূর্বাভাস ছিল গত মার্চ-এপ্রিলেই। ঢাকায় বিভিন্ন এলাকার জরিপ থেকে এডিস মশার বাড়বাড়ন্তের তথ্য জানা যাচ্ছিল। মৌসুমের আগেই আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছিল। পত্রিকায় আগাম সতর্কতা জানিয়ে একের পর এক খবর প্রকাশ করা হয়েছে। সম্পাদকীয় লিখে আগেভাগে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা তাঁদের সাক্ষাৎকার লেখায় সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু সবকিছুই ‘সৃজনশীল’ পথে উপেক্ষা করা হয়েছে।

ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারার অবৈজ্ঞানিক ও অকেজো পদক্ষেপ আর কিছু ভবনমালিককে জরিমানা করা ছাড়া ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কেউ আবার এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতার গল্পও শুনিয়েছেন। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখে জনস্বাস্থ্যবিদেরা স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেটাও কেউ কানে তোলেননি। ফলে জেনেবুঝেই যে মানুষকে এই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ডেঙ্গুতে ২০১৯ সালের বিপর্যয়ের যে অভিজ্ঞতা, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, তা থেকে মেয়র ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কেউই শিক্ষা নেননি।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আমাদের হাসিখুশি শিশুরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন শিশুর জন্ম দিতে আমাদের মায়েরা ভয় পাচ্ছেন। মাননীয় মেয়র ও মন্ত্রীরা, আপনারা দয়া করে আপনাদের ‘সৃজনশীলতা’ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের দুঃসহ যন্ত্রণার কথা, মানুষের দীর্ঘশ্বাসের কথা, মানুষের হাহাকারের কথা শুনুন। মশা মারার বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নিন।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী