পুরুষেরও জানা দরকার ‘পিরিয়ড স্বাস্থ্য’ কী, ‘পিরিয়ড দারিদ্র্য’ কী

পিরিয়ড স্বাস্থ্যকে সাধারণত পিরিয়ড চক্রের সঙ্গে সম্পর্কিত শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পিরিয়ড স্বাস্থ্য পরিচর্যার অংশ হিসেবে পিরিয়ড হয় এমন সব নারী, মেয়ে ও অনেক তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরও পিরিয়ড চক্র সম্পর্কে শিক্ষা থাকা জরুরি।

পাশাপাশি প্রয়োজনীয় স্যানিটারি পণ্যগুলো ব্যবহারের সুযোগ থাকা জরুরি, যাতে তাঁরা পিরিয়ডের সময় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন করতে পারেন।

এ ছাড়া পিরিয়ড হওয়া ব্যক্তিদের জন্য কার্যকর এবং সাশ্রয়ী মূল্যের স্যানিটারি পণ্য, পরিষ্কার পানি, সাবানসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর নিরাপদ ব্যবহারের সুযোগ থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক কুসংস্কার ও মানসিক যন্ত্রণামুক্ত পরিবেশে পিরিয়ড স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সব নারী ও মেয়ের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা বেশ জরুরি। তবে যখনই কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বাধার জন্য পিরিয়ডের সময় কেউ পিরিয়ড স্বাস্থ্যের যথাযথ চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হন কিংবা কোনো নাগরিক সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হন, তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় ‘পিরিয়ড দারিদ্র্য’।

সহজ ভাষায়, আর্থিক বা তথ্যগত সীমাবদ্ধতার কারণে স্যানিটারি পণ্যের দুষ্প্রাপ্যতা এবং দুর্বল ‘পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা’র আরেক নাম হলো পিরিয়ড দারিদ্র্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফ পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নারী ও কিশোরীদের পিরিয়ডের সময় নিরাপত্তা ও স্বস্তির সঙ্গে পরিষ্কার উপকরণ ব্যবহার করতে পারার ওপর জোর দিয়ে থাকে।

পাশাপাশি বাড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে সাবান, নিরাপদ পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

পিরিয়ড দরিদ্র্য নারীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে স্কুলে মেয়েদের অনুপস্থিতি, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অনুপস্থিতি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতাসহ নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পিরিয়ড দারিদ্র্যের অসংখ্য প্রভাব উঠে এসেছে নানা গবেষণায়।

উপরন্তু নারী ও মেয়েদের পিরিয়ড চক্র ও তার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সমাজের সবার প্রাথমিক জ্ঞান ও ইতিবাচক মনোভাব পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সামগ্রিকভাবে তাই পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধির ব্যবস্থাপনা বেশ কিছু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা, জেন্ডারসমতা নিশ্চিত করা, নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশনের প্রাপ্যতা এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা অন্যতম।

বিশ্ব ব্যাংকের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিদিন ৩০ কোটির বেশি নারী, মেয়ে ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যান। এর মধ্যে অনেকেই পিরিয়ডসম্পর্কিত যথার্থ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারেন না।

অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতোই বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারী ও কিশোরীর, বিশেষ করে যারা গ্রামীণ ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, তাদের পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ও আনুষ্ঠানিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ নারী ও কিশোরী তাদের পিরিয়ডের সময় কাপড় বা অন্যান্য উপকরণ যেমন ন্যাকড়া কিংবা কাগজের তোয়ালে ব্যবহার করে, যা সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আয়ের স্বল্পতা, পিরিয়ডসম্পর্কিত সঠিক জ্ঞানের অভাব, কুসংস্কারে বিশ্বাস, পিরিয়ড সম্পর্কে পুরুষ সদস্যদের অসংবেদনশীলতা, স্কুল কিংবা কর্মক্ষেত্রে সাবান, পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন সুবিধার অভাবের কারণে বাংলাদেশে উচ্চ হারে পিরিয়ড দারিদ্র্য লক্ষণীয় বলে অনেক সামাজিক গবেষণায় পাওয়া যায়।

ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ অনুসারে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় ৫০ শতাংশ কিশোরী এবং ২০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৬৪ শতাংশ নারী তাঁদের পিরিয়ডের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন।

একই জরিপে উঠে এসেছে যে দেশের মাত্র ৩৫ শতাংশ প্রাথমিক ও ৭৩ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট রয়েছে এবং মাত্র ২৪ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩৮ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের টয়লেটে পানি ও সাবান উভয়ই রয়েছে।

অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ স্কুলের টয়লেটে ব্যবহারযোগ্য পানি সরবরাহের অভাব রয়েছে এবং অধিকাংশ স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। এর ফলে, যদিও অনেকেই পিরিয়ডের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কেনার সামর্থ্য রাখে, তবু তারা তাদের স্কুল বা কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত জায়গা, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, পানি ও সাবানের অভাবে পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তনসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।

পিরিয়ড দরিদ্র্য নারীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে স্কুলে মেয়েদের অনুপস্থিতি, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অনুপস্থিতি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতাসহ নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পিরিয়ড দারিদ্র্যের অসংখ্য প্রভাব উঠে এসেছে নানা গবেষণায়।

ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৪১ শতাংশ স্কুলগামী মেয়ে পিরিয়ড–সংক্রান্ত সমস্যার কারণে বছরে প্রায় ১৬ শতাংশ ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হয়। অধিকন্তু, পিরিয়ড দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাস্তবতায় নারীদের মধ্যে এক নতুন ধরনের সামাজিক স্তরবিন্যাস ও বৈষম্য লক্ষ করেছেন গবেষকেরা।

যেসব মেয়ে ও নারীর বাড়িতে ও স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সঠিক তথ্য ও পণ্যের ঘাটতি নেই, তাঁদেরা সাধারণত পিরিয়ডের কারণে স্কুলে বা কাজে ছাড় দিতে হচ্ছে না।

অপর দিকে, যেসব মেয়ে ও নারীর বাড়িতে ও স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সঠিক তথ্য ও পণ্যের ঘাটতি রয়েছে, তাঁদের পিরিয়ড–সংক্রান্ত সমস্যার জন্য স্কুলে বা কাজে ছাড় দিতে হচ্ছে।

এমতাবস্থায়, যেহেতু পিরিয়ড দারিদ্র্য মেয়ে ও নারীদের জীবন ও জীবিকাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এটি নিঃসন্দেহে নিম্ন আয়ের এবং প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকেও প্রভাবিত করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে পিরিয়ড দারিদ্র্যের সমাধান করতে হলে অবকাঠামোগত ও গুণগত উভয় রকম পরিবর্তনই প্রয়োজন।

এ সমস্যার ‘হার্ডওয়্যার’ ও ‘সফটওয়্যার’ উভয় দিক নিয়েই কাজ করতে হবে। একদিকে স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট, সাবান, পরিষ্কার পানি ও স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো হার্ডওয়্যারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, পিরিয়ড সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণার (অর্থাৎ, সফটওয়্যার) পরিবর্তন করাও জরুরি, যাতে নারীরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পিরিয়ড স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

স্যানিটারি পণ্যকে সবার জন্য আরও সুলভ ও সহজলভ্য করাও জরুরি, যাতে নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীরা ক্রয়ক্ষমতা কম থাকার কারণে উপযুক্ত স্যানিটারি পণ্যের পরিবর্তে সস্তা ও অস্বাস্থ্যকর পণ্যকে বিকল্প হিসেবে বেছে না নেন। এ ক্ষেত্রে পিরিয়ড স্বাস্থ্য এবং পিরিয়ড দারিদ্র্যের সমস্যাটি সংশ্লিষ্ট সব সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই কেবল সমাধান করা সম্ভব।

  • ডালিয়া রহমান সামাজিক উদ্যোক্তা ও গবেষক

  • মো. ইমরান হোসেন ভূঁইয়া সহকারী অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।