রোমানিয়ার বুখারেস্টে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়া ন্যাটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ১০ মাসে পড়া রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। বাইডেন প্রশাসনের কারণে এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি চীনও ছিল ন্যাটোর আলোচনার আরেকটি মূল বিষয়। এ ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন আংশিকভাবে হলেও সফল হয়েছে। কেননা, ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চেষ্টা করবে বলে বিবৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া বেইজিংয়ের কাছে ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরও ভালোভাবে সমন্বয় করা হবে বলেও জানিয়েছে তারা।
এ বিষয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই যে গত কয়েক বছরে চীনের বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সামর্থ্য নিয়ে ন্যাটোর সদস্যরা এক সুরে কথা বলে এসেছে। সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীনের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তারা সমানভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে।
সম্প্রতি সি চিন পিং চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে নিজের ক্ষমতা সংহত করে তৃতীয় মেয়াদের জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
ঐতিহ্যগতভাবে ন্যাটো চীনকে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করে না। কিন্তু চীনের অবস্থান ও আচরণের ওপর ভিত্তি করে বেইজিংয়ের প্রতি বৈরী না হলেও সন্দেহপ্রবণ অবস্থান বজায় রেখে চলে। ২০১৯ সালে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ
বলেছিলেন, চীনের উত্থানে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সুযোগও তৈরি হয়েছে। ২০২২ সালে এসে ন্যাটোর সেই কৌশলগত অবস্থান অনেকটা বদলে গেছে। গত সপ্তাহের সভা শেষে দেওয়া বিবৃতিতে চীনের জন্য রাখা অনুচ্ছেদে বেইজিংয়ের ‘জবরদস্তিমূলক নীতিগুলো’ এবং রাশিয়ার সঙ্গে দর–কষাকষির অংশীদারত্ব—এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
চীনকে লক্ষ করে ন্যাটো পরিকল্পনা বদল করলে যেকোনো অর্থেই জোটটিকে বড় মূল্য চুকাতে হবে। যদিও সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এরপরও কয়েকটি কারণে চীনকে ঠেকাতে ন্যাটো যথাযথ মঞ্চ নয়।
কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে শান্তি আলোচনার দূরবর্তী কোনো আলো এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ফলে ২০২৩ সালেও এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে দুই পক্ষই আরও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। এ ছাড়া ন্যাটো জোট নিজেই এখন অসংখ্য সমস্যায় নিমজ্জিত। সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্য অসামঞ্জস্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাই ৭০ শতাংশ সামরিক ব্যয় বহন করে। এ ক্ষেত্রে ন্যাটোর অন্য ধনী দেশগুলোর রাজনৈতিক ইচ্ছার ঘাটতি প্রবল।
প্রথমত, চীনকে ঠেকানো ন্যাটোর প্রধান কাজ হলে জোটটিকে এত বেশি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন হবে যে এর অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়বে। শীতল যুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হামলার হুমকি মোকাবিলায় ইউরোপীয় দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ন্যাটো গড়ে তুলেছিল। ন্যাটো বা উত্তর আটলান্টিক চুক্তির প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, এই জোট ‘উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের’ একটি উপায়। ভৌগোলিকভাবে ন্যাটোর পূর্ব সীমান্ত থেকে চীন আড়াই হাজার মাইলের চেয়েও দূরে অবস্থিত।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপে এখন যখন একটা সংঘাত চলমান, তখন ন্যাটো কেন নিজের সীমানার বাইরে বের হবে? রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ সবে ১০ মাস পেরিয়েছে, কিন্তু এরই মধ্যে এই যুদ্ধ মহাদেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক সংঘাতে রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষেই কমপক্ষে এক লাখ করে হতাহত হয়েছেন।
কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে শান্তি আলোচনার দূরবর্তী কোনো আলো এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ফলে ২০২৩ সালেও এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে দুই পক্ষই আরও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। এ ছাড়া ন্যাটো জোট নিজেই এখন অসংখ্য সমস্যায় নিমজ্জিত। সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্য অসামঞ্জস্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাই ৭০ শতাংশ সামরিক ব্যয় বহন করে। এ ক্ষেত্রে ন্যাটোর অন্য ধনী দেশগুলোর রাজনৈতিক ইচ্ছার ঘাটতি প্রবল।
পরিশেষে, চীনকে কেন্দ্রে রেখে ন্যাটো যদি নিরাপত্তাকৌশল সাজায়, তাহলে এর ভূরাজনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে, সেটা জোটটির নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। ন্যাটো যদি এদিকে মনোযোগ দেয়, তাহলে বেইজিং কৌশলগতভাবেই মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
● ডানিয়েল ডেপেট্রিস শিকাগো ট্রিবিউন ও নিউজউইক–এর পররাষ্ট্র বিষয়ে কলাম লেখক