মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইং ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই
মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইং ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই

মিয়ানমারে চীনবিরোধী মনোভাব কেন বাড়ছে

মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে সীমান্ত আছে ২,২২৭ কিলোমিটার। এই দুই দেশের সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় ‘পাউক-ফাও’ বা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু বাস্তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি চীনের সমর্থন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণের কারণে মিয়ানমারে চীনবিরোধী মনোভাব রয়েছে প্রবলভাবে।

স্বাধীন গবেষক নিন ফিউ পরিচালিত একটি অনলাইন জরিপে দেখা গেছে, ‘মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে চীনের প্রতি প্রতিকূল মনোভাব ব্যাপকভাবে বাড়ছে। তাদের অনেকে বিশ্বাস করেন, খণ্ডিত মিয়ানমারে চীন তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আগ্রহী নয়।’  

মিয়ানমারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব রয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, জনগণ ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করে যে চীন সরকার তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে এ অভাবের সুযোগ নিচ্ছে। মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রতিরোধের কারণে যেসব প্রকল্প থেমে আছে, সেগুলো আবার শুরু করার জন্য চীন সামরিক জান্তাকে সমর্থন করে যাচ্ছে।  উত্তরদাতাদের সিংহভাগ (৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ) বলেছেন, মিয়ানমারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে চীন।

বাস্তবে  চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের নয়। এ সম্পর্ক আসলে এক অস্বস্তিকর সহাবস্থান। আর দুই দেশের সম্পর্ক কেমন করে ‘পারস্পরিকভাবে লাভজনক’, তা–ও বলা কঠিন। এখন পর্যন্ত এ সম্পর্ক তো একটি পক্ষের জন্যই লাভজনক বলে মনে হচ্ছে।  

দ্য ইরাবদি সম্পাদক কিয়াউ জওয়া মোর মতে, জনগণের মধ্যে এ ধারণা ব্যাপকভাবে চালু আছে যে চীন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে ভীষণ লোভী ও শোষক। ১৯৮৮ সালের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে পূর্ববর্তী সামরিক শাসনের প্রতি জোরালো সমর্থন দিয়ে চীন নিন্দিত হয়েছিল। এ ভাবনা সমর্থন করে কলামিস্ট বো বো বলছেন, স্থগিত মাইটসোন বাঁধ প্রকল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনের জেদ, মিয়ানমারের প্রতি চীনা প্রবাসীদের কটু আচরণ এবং বার্মিজ ঔপন্যাসিক ও বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখি চীনের প্রতি মিয়ানমারের জনগণের বিরোধিতা গড়ে তুলতে অবদান রেখেছে।

মিয়ানমারে চীনের রাষ্ট্রদূত চেন হাই এ বছরের শুরুর দিকে জান্তা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সুয়ের সঙ্গে নেপিদোতে দেখা করেছিলেন। সাক্ষাতে তিনি চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে অনলাইন প্রচারণা বন্ধ করা আর দুই দেশের মধ্যে ‘পারস্পরিকভাবে লাভজনক’ সহযোগিতার ওপর জোর দেন। সেই সঙ্গে সীমান্তে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ রক্ষার বিষয়টিও আলোচিত হয়। বাস্তবে  চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের নয়। এ সম্পর্ক আসলে এক অস্বস্তিকর সহাবস্থান। আর দুই দেশের সম্পর্ক কেমন করে ‘পারস্পরিকভাবে লাভজনক’, তা–ও বলা কঠিন। এখন পর্যন্ত এ সম্পর্ক তো একটি পক্ষের জন্যই লাভজনক বলে মনে হচ্ছে।  

দুটি স্পষ্ট উপায়ে সামরিক জান্তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে চীন। প্রথমত, সামরিক সাহায্য। অনেকেই মনে করেন, চীনের দেওয়া বিমানশক্তি না থাকলে জান্তা অনেক আগেই পরাজিত হয়ে যেত। বিষয়টি বুঝেই চীন সম্প্রতি আরও ছয়টি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে। শান, রাখাইন, কাচিন ও কায়াহ রাজ্য এবং সাগাইং অঞ্চলে বেসামরিক জনগণের ওপর জান্তার বিমান হামলা বাড়াতে ঠিক সময়ে পৌঁছেছিল বিমানগুলো।

দ্বিতীয়ত, জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ করার জন্য জাতিগত প্রতিরোধ শক্তিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে চীন। প্রতিরোধ জোটের সদস্য, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সাধারণ সম্পাদক ভোনে কিয়াও। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তিনি বলেছেন যে জান্তার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হয়েছে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধবিরতি হয়েছে আসলে চীনের চাপে। চীন একই সঙ্গে জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিক মিত্রতা না করতে বাধ্য করেছে।

চীনের চাপ ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বাইরেও প্রসারিত। তারা কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মিকে জান্তার সঙ্গে লড়াই বন্ধ করার এবং প্রতিরোধগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে চাপ দেওয়ার জন্য তাদের সীমান্ত চেকপয়েন্টগুলো বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।

সংক্ষেপে মিয়ানমারের বর্তমান ঘটনাবলিতে চীনের ভূমিকাকে মিয়ানমারের জনগণের হাত থেকে সামরিক জান্তাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। আর এর উদ্দেশ্য একটাই—বেইজিংয়ের নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। ভালো দায়িত্বশীল প্রতিবেশী হওয়ার কোনো ইচ্ছে সেখানে নেই। তবে চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ানমারের বিপ্লবকে সমর্থন করে নিজেদের সদিচ্ছা দেখানোর এক সুযোগ এসেছে এখন। সরাসরি সমর্থন যদি করা না যায়, তাহলে চীন অন্তত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

এই পটভূমিতে হস্তক্ষেপ না করা মানে পাশ থেকে পর্যবেক্ষণ করা। কোনো পক্ষকে সমর্থন না করা বা কোনো গোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টি না করা। শুধু নিষ্ক্রিয় থাকলেই মিয়ানমারের জনগণ চীনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। সোজা কথায় চীন যদি সাহায্য করতে না চায়, অন্তত ঝামেলা না করুক।

  • জুং রিং সমাজকর্মী এবং মিয়ানমারভিত্তিক স্বাধীন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    দ্য ইরাবদি থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত