অনেক বিতর্কের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে অচলাবস্থা দূর করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে জোর দাবি জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও। তারা চায়, কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়া একটি খোলামেলা সংলাপ।
এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় হচ্ছে না। এর মধ্যে একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর অনুসারে, সংকট উত্তরণে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে এর কিছু নেতৃস্থানীয় সদস্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন।
সংকট ঘনীভূত হয়েছে অনেকটা। এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে এর ডালপালাও মেলছে। চলমান হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি। এর আগে দুই দফায় এফবিসিসিআই এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে। সেই বিবৃতিতে হরতাল-অবরোধে দেশের শিল্প-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানির ক্ষয়ক্ষতি ও জনদুর্ভোগের কথা রয়েছে। বৃহত্তর বলয়ে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হয়েছে। বিবৃতি দুটি গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনার দাবি রাখে। বিবৃতিদাতা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান দেশের শিল্প-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে সর্বোচ্চ।
দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে তাদের ভূমিকা স্বীকার করতেই হবে। সেই ভূমিকা শুধু প্রবৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ নয়, রয়েছে দেশের বিশালসংখ্যক শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান বিষয়। শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে দেশের অবকাঠামো, ব্যাংক-বিমা, পরিবহনসহ অন্যান্য খাতেরও প্রসার ঘটছে। তবে তাদের বিবৃতি দুটি যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তেমনটা পায়নি।
কারণ, সেই বিবৃতিতে সংকটের মূল কারণগুলো হয়নি আলোচিত। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ভূমিকাও অনালোচিত রয়ে গেছে। খোলামেলাভাবে বলতে গেলে, হরতাল-অবরোধের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আলোচনায় এর উৎস এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা আলোচনা করাই যৌক্তিক। সেই বিষয়গুলো বিবৃতি দুটোয় পাশ কাটানো হয়েছে। তবে হাল উদ্যোগটি অনেক ব্যাপকভিত্তিক হতে পারে বলে ধরে নেওয়া যায়।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে হরতাল-অবরোধজাতীয় কর্মসূচি ক্ষতিকর জেনেও বিরোধী দলে থাকা সব দল এর চর্চা করে। এ কারণে অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি জনভোগান্তি আন্দোলনকারীদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। এমনটা প্রথমবারের মতো হলো, তা নয়। বরং বলতে হবে বরাবরই হয়। তবে গত প্রায় পাঁচ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের কর্মসূচি ছিল না। এটা অবশ্য কোনো আনুকূল্য থেকে নয়, বিরোধী দলগুলো এ সময়কালে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। তবে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিয়েছে।
২০২৪-এর সূচনায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রচেষ্টায় প্রায় এক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে আন্দোলনটি সংগঠিত হয়। দেশের মানুষ এবং ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে আর আগ্রহী নন। এই সময়কালে সরকারের পক্ষ থেকে অতীতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বিরোধী দলের কর্মসূচির প্রতি অনেকটা সহনশীল মনোভাবই দেখা গেছে।
আর কিছু কিছু প্ররোচনা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো এতে প্রায় অহিংস আইনানুগ প্রক্রিয়ায় ছিল সীমাবদ্ধ। উল্লেখ করতে হবে, বিরোধী দলগুলোর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মাঠের একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি। তাদের মূল দাবি নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করার।
এ ধরনের দাবি মেনে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই নেতিবাচক উত্তর পাওয়া গেছে। বিএনপিও বিষয়টিতে কোনো ছাড় দিতে সম্মত নয়। আর এর জন্য দুই পক্ষের মধ্যে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনাই হয়নি। দেশের সুশীল সমাজসহ কোনো সামাজিক শক্তিই এ ধরনের একটি সংলাপের উদ্যোগ নেয়নি। সমস্যা রয়েছে জেনেও নির্বাচন কমিশনকে অনেকটা নির্বিকারই দেখা গেছে।
এ ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তির ক্রমবর্ধমান তৎপরতা লক্ষণীয় হতে থাকে। এটা নতুন কিছু নয়। বরং অতীতের ধারাবাহিকতা বলা চলে। আর এবার অগ্রণী ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্র। তাদের অবস্থান একটি শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের জাতীয় নির্বাচনের সপক্ষে। এ বিষয়ে তারা সব পক্ষের সঙ্গেই দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নির্বাচনের তফসিল সামনে রেখেও সব পক্ষের মধ্যে একটি শর্তহীন সংলাপের আবেদন তাদের রয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা বাংলাদেশের জন্য একটি ভিসা নীতিও চালু করেছে। মানবাধিকার ইস্যুতে আগে থেকেই রয়েছে র্যাবের ওপর স্যাংশন।
ঠিক তেমনি আশঙ্কা রয়েছে, একটি সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে আমাদের অর্থনীতিকে দিতে হতে পারে অনেক মূল্য। তদুপরি আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথ হয়ে পড়বে আরও বন্ধুর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণ। ঠিক এ সময়ে এফবিসিসিআইয়ের আলোচিত উদ্যোগটির দিকে আমাদের নজর ও সমর্থন থাকবে, এমনটাই স্বাভাবিক।
এফবিসিসিআই নেতারা আনুপূর্বিক ঘটনাবলি জানেন। একটি সময় পর্যন্ত সবকিছুই মোটামুটি ঠিকঠাক চলছিল। গত ২৮ অক্টোবরে আয়োজিত বিএনপির মহাসমাবেশটি আকস্মিকভাবেই ভন্ডুল হয়ে যায়। এর আগে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলাসহ কিছু অযাচিত ঘটনার অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে উভয় পক্ষ থেকে বিপরীতধর্মী বক্তব্য রয়েছে। বক্তব্য আছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সমাবেশকে কেন্দ্র করে একজন পুলিশ কনস্টেবল, একজন সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজনের বেদনাদায়ক প্রাণহানি ঘটেছে। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়েছেন সমবেত জনতা।
শক্তি প্রয়োগের মাত্রার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অকুস্থল থেকে গ্রেপ্তার শুরু হয়। এর পর থেকেই বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেক নেতাই হয়েছেন গ্রেপ্তার। অনেককেই নেওয়া হয়েছে রিমান্ডে। পালিয়ে আছেন অনেক নেতা-কর্মী। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসটি হয়ে যায় তালাবদ্ধ।
এর সামনে বেশ কিছুদিন ছিল পুলিশ। ঠিক নির্বাচন তফসিল ঘোষণার সামান্য আগে এ ধরনের ঘটনায় অনেকটা একতরফা হয়ে যায় নির্বাচনের মাঠ। তবে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে চলছে। কেউ না কেউ আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে যানবাহনে। দূরপাল্লার পরিবহনব্যবস্থা হয়ে পড়েছে স্তিমিত। ফলে জনজীবনে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কাবস্থা। অন্যদিকে তফসিল ঘোষণা করায় এ ধরনের কর্মসূচি জোরদার হচ্ছে।
এমনভাবে একটি নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। তদুপরি একটি শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা হবে দূরীভূত। মাঠে ভালো খেলোয়াড় না থাকলে সেই খেলা দেখতে দর্শকেরা যান না। তেমনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে কমে যেতে পারে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি। ফলে ঈপ্সিত স্থিতিশীলতাও আসবে না। যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবু এফবিসিসিআই একটি জোরালো উদ্যোগ নিলে সমাধানের পথে কিছুটা হলেও অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
বিবদমান দুই পক্ষকেই বুঝতে হবে, রাজনীতি আপস ও সমঝোতার একটি খেলা। অবস্থান থেকে সরা যাবে না—এমন কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য থাকতে পারে না। বলতে হয়, চলমান যুদ্ধের পাশাপাশিও শান্তির সংলাপ চলে। এ ক্ষেত্রে এফবিসিসিআই দৃঢ় অবস্থান নিলে সংকট থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ ঘটতে পারে। তাদের অনেক সদস্যই দুটি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তদুপরি যুগবাহিত রেওয়াজ অনুসারে আজও এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের আর্থিক সহায়তা আবশ্যক হয়। অপরিবর্তনশীল কোনো বিষয় নয় তফসিল। তেমনি সংবিধান সংশোধনের দাবি করাও নয় অসাংবিধানিক।
শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নেতারা নিশ্চয়ই বোঝেন, তাঁদের বহু শ্রম ও মেধায় অর্জিত সাফল্যকে বিপরীত দিকে চালু করা যাবে না। তেমন অধিকার কারও নেই। এটা দায়িত্ব নিয়ে বোঝাতে হবে বিবদমান পক্ষদের। রাজনীতিতে শেষ কথা ও শেষ সময় বলে কিছু নেই। সুতরাং তারা চাইলে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার অজুহাতেও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে না বলে আমরা আশাবাদী।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com