কেনিয়ার সফল বিক্ষোভের ঢেউ এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।
কেনিয়ার সফল বিক্ষোভের ঢেউ এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।

আরব বসন্তের ঢেউ যেভাবে আছড়ে পড়ছে আফ্রিকার দেশে দেশে

১০০ দিনের মধ্যে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে ক্ষমতায় এসেছিলেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো। কিন্তু কেনিয়ার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হন তিনি। তাতে তাঁর দেশে যে অসন্তোষের ঢেউ শুরু হয়েছে, তা দেশের বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

 ১৮ জুন একটি বিতর্কিত কর বিলের বিরোধিতা করে হাজারো কেনিয়ান তরুণ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। বিলটি পাস হলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। রুটো খুব দ্রুত বিলটি থেকে করের হার কিছুটা কমানোর ঘোষণা দেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তাঁর সেই প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। যত দিন যাচ্ছিল, ততই বেশিসংখ্যক মানুষ বিদ্রোহে যুক্ত হচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তাঁরা পার্লামেন্টে ঢুকে তছনছ করেন।

 পুলিশ বলপ্রয়োগ বিক্ষোভকারীদের ছত্রখান করে দিতে চেষ্টা করে। কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন, আহত হন কয়েক শ।

 ঘটনার ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে ২৬ জুন রুটো হাল ছেড়ে দেন এবং তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসেন।

যাহোক, বিতর্কিত সেই বিল থেকে সরে আসার পরও জনগণের ক্ষোভ প্রশমন হয়নি। সে কারণে আন্দোলন থামাতে নতুন প্রচেষ্টায় নামেন তিনি। মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। মন্ত্রিসভার ব্যাপক রদবদলও প্রতিবাদকারীদের অটলতাকে টলাতে ব্যর্থ হয়। কেনিয়ার জনগণ রুটোর পদত্যাগের দাবিতে এখনো রাস্তা থেকে ঘরে ফিরে যাননি।

 বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে একটা নির্বাচন নিশ্চিত করার আগে তাঁরা ঘরে ফিরে যাবেন, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না।

 বিতর্কিত কর বিল প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও কেনিয়ায় বিক্ষোভ অব্যাহত থাকার পেছনে স্পষ্ট কারণ রয়েছে। পুঞ্জীভূত সংকট একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ফেটে বেরিয়ে পড়েছে। কর বাড়ানোর বিলটি এ ক্ষেত্রে উটের পিঠ ভেঙে দেওয়ার সর্বশেষ খড়ের আঁটি হিসেবে কাজ করেছে। মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপর্যুপরি ব্যর্থতা, আর্থসামাজিক সমর্থনের ঘাটতি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসার মতো বিস্তর কারণ তো রয়েছে। কেনিয়ার জনগণকে তাঁদের পাতে খাবার জোগাড় করতে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সমাজে ব্যাপক বৈষম্য ও দারিদ্র্য রয়েছে। তাঁরা একটা পদ্ধতিগত পরিবর্তন চাইছেন এবং সেই পরিবর্তনটার এখনই বাস্তবায়ন চান।

অঙ্গোলা, নামিবিয়া, মোজাম্বিক ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও নিকট অতীতে প্রতিবাদ হয়েছে। দুর্নীতি, অসাম্য ও অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে এসব দেশ যেভাবে ধুঁকছে, তাতে যেকোনো সময় সুশাসন, বৈষম্য ও শক্তিশালী গণতন্ত্রের দাবিতে গণবিস্ফোরণ যেকোনো সময় আছড়ে পড়তে পারে।

কেনিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে ২০১০ সালে তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থানের প্রথম দিককার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট একটা ভ্যানে সবজি বিক্রেতা পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ করেন। কয়েক দিন পর তিনি মারা যান। পরবর্তী সময় তাঁর এই আত্মাহুতির ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় এবং দেশটির জনগণের জীবনযাত্রার মান ও কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট বেন আলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুনে ঘিয়ের জোগান দেন।

এই একটা ঘটনায় বানের জোয়ারের মতো মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। বেন আলির দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ও তিউনিসিয়া গণতন্ত্রের অভিমুখে যাত্রা শুরু না করার আগপর্যন্ত রাস্তা ছেড়ে যাননি তাঁরা।

 তিউনিসিয়া থেকে উদগত হওয়া গণতন্ত্র ও সুশাসনের দাবি দাবানলের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যা পুরো অঞ্চলে গণতান্ত্রিক জাগরণ তৈরি করে। যেটাকে আমরা আরব বসন্ত বলি।

 সেই ঘটনার ১০ বছরের বেশি সময় পর আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে একই ঘটনা ঘটছে বলে আমার সন্দেহ। আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে খারাপ শাসকদের জয়জয়কার। কেনিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনের সংকল্প মহাদেশজুড়ে প্রতিবাদের জোয়ার সৃষ্টি করতে পারে ও পরিণতিতে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটাতে পারে।

 কেনিয়ার সফল বিক্ষোভের ঢেউ এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।

আগস্টের ১ তারিখ থেকে #ইন্ডব্যান্ডগভর্নেন্সইননাইজেরিয়া#- (নাইজেরিয়ায় খারাপ শাসনের অবসান) দাবিতে হাজার হাজার মানুষ নাইজেরিয়ায় বিক্ষোভ শুরু করেছেন।

কেনিয়ার জনগণের মতোই নাইজেরিয়ার প্রতিবাদকারীরা অপশাসন ও দুর্নীতির অবসান চান এবং লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো এসব দাবিতে তাঁরা রাস্তায় নেমে আসেন। প্রথম দিকে রুটোর মতোই প্রেসিডেন্ট বোলা তিনুবু সহিংসতা চালিয়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করেছে, নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী কমপক্ষে ১৩ জন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে। আহত করেছে আরও অনেককে। শয়ে শয়ে মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও এই দাবিকে অস্বীকার করেছে নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী।

পুলিশ যখন কঠোরভাবে বলপ্রয়োগ করেও জনবিক্ষোভ দমাতে পারল না, তখন তিনুবু বলতে শুরু করলেন, তিনি জনগণের দাবি শুনতে রাজি ও আলোচনায় বসতে রাজি।

 কিন্তু তিনুবুর আলোচনার সেই প্রস্তাব বিক্ষোভকারীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। তাঁরা ঘরে ফিরে যাননি। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় থেকে যাওয়ায় তিনুবুর হাতের বিকল্প ফুরিয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্তভাবে সরকার পতন ও দেশের নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।

সাব-সাহারা অঞ্চলের অন্য দেশ, যেগুলো দুর্নীতি, অসাম্য, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত, কেনিয়ার বিক্ষোভ সেসব দেশের সরকারগুলোকেও চাপে ফেলে দিয়েছে।

উগান্ডায় ২১ জুলাই জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশন ভাষণে প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি দেন যে তাঁরা আগুন নিয়ে খেলছেন। তার কারণ হলো, দেশটির বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট অভিমুখে দুর্নীতিবিরোধী মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। এরপর ২৩ জুলাই বিক্ষোভের ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উগান্ডার তরুণেরা যখন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছিলেন, তখন পুলিশ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করে।

জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন মনানগাওয়ার মধ্যেও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে যে তাঁর দেশে বিপ্লবের ঢেউ আছড়ে পড়বে কি না।

অঙ্গোলা, নামিবিয়া, মোজাম্বিক ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও নিকট অতীতে প্রতিবাদ হয়েছে। দুর্নীতি, অসাম্য ও অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে এসব দেশ যেভাবে ধুঁকছে, তাতে যেকোনো সময় সুশাসন, বৈষম্য ও শক্তিশালী গণতন্ত্রের দাবিতে গণবিস্ফোরণ যেকোনো সময় আছড়ে পড়তে পারে।

কেনিয়ার আন্দোলন খুব পরিষ্কারভাবে আফ্রিকার তরুণদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন নিশ্চিত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করছে।

আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের তরুণদের মধ্যে দুর্নীতি, অদক্ষতা, দমনমূলক সরকারব্যবস্থার প্রতি মোহভঙ্গ ঘটেছে। তাঁরা তাঁদের আওয়াজ জানান দিতে রাস্তায় নেমে এসেছেন। দিগন্তরেখায় আফ্রিকান বসন্ত দেখা যাচ্ছে।

  •  টাফি মাখা আল-জাজিরার কলাম লেখক

  • আল-জারিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ : মনোজ দে