গবেষণার অনেকগুলো নিয়ম আছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো বিষয় নিয়ে লেখা। পত্রপত্রিকায় কোনো বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হলে সেগুলো সঠিক না হওয়ার বিষয়ে বিপরীত কোনো বক্তব্য বা তথ্য না পাওয়া গেলে ওই সব তথ্য মোটামুটি সত্য বা বিশ্বাসযোগ্য ধরে নিয়ে বিশ্লেষণ এবং মতামত দেওয়া যায়। এই গৌড়চন্দ্রিকার কারণ, যে বিষয়গুলো নিয়ে এ লেখার অবতারণা করছি, সেগুলোর উৎস বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ছয়টি উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম। এমনকি নির্বাচন কমিশনের সূত্রমতে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। এই সংখ্যা কমার পেছনে যত যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন, তথ্য বিশ্লেষণে এটা পরিষ্কার যে প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনে ভোটাররা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
বিগত বছরগুলোতে বেশির ভাগ, বিশেষ করে উপনির্বাচনগুলো এবং স্থানীয় সরকার বহু বছর ধরে প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়ায় ভোটার ভোটকেন্দ্রে আসার তাগিদ হারিয়ে ফেলেছেন।
তেমনি মাত্রাছাড়া অনিয়মের কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে মাত্রায় ধস নেমেছে, তাতে একতরফাভাবে নির্বাচনে প্রার্থীরাও ভোটারদের উপস্থিতির বিষয়টি গৌণ মনে করছেন। বড় বিষয় হলো ভোটারদের সামনে কী ধরনের বা কোন ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে, ওই ব্যক্তি আদৌ ভোটারদের পছন্দের কি না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের যে সংস্কৃতি ২০১৪ সাল থেকে চালু হয়েছে, সে প্রক্রিয়া স্থানীয় নির্বাচনগুলোকেই দারুণ প্রভাবিত করেছে।
এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো গবেষণা আছে বলে মনে হয় না। যার কারণেই নির্বাচন কমিশন খেই হারিয়ে ফেলছে এবং তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে ব্যাঘাত ঘটছে। কিছুদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে উপনির্বাচনটি হয়েছিল, সেখানে একজন প্রার্থী নির্বাচনের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে নির্বাচন পর্যন্ত নিখোঁজ অবস্থায় ছিলেন। এ ধরনের গুরুতর ঘটনা দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
ভোটের কয়েক দিন আগে নির্বাচন কমিশন মুখ রক্ষার্থে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর ফলাফল জানার আগেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। অথচ মাঠ প্রশাসনের বদলে কমিশনের উচিত ছিল নিজেই তদন্ত করা এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত রাখা। নির্বাচনের পর সেই নিখোঁজ প্রার্থী বলেছেন, তিনি কেন আত্মগোপন করেছিলেন, তা তাঁর প্রতিপক্ষ সরকারি দল আওয়ামী লীগের কর্মীরাই বলতে পারবেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে এমন ঘটনা আরও দেখা যাবে কি না, তা সময়ই বলবে। আমার মতে, এখানে নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি অথবা করতে চায়নি। যার কারণে কমিশনের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি বাড়বে বই কম হবে না। ব্যবস্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার ঘাটতি ভোটারদের নিরুৎসাহিত করছে।
হিরো আলমের নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, তাঁর উত্থানের মাধ্যমে যে দু-একটি বার্তা পাওয়া গেছে, তার একটি হচ্ছে পুরোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটাররা একধরনের প্রতিবাদী ভোট দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অন্য বার্তাটি হচ্ছে, শুধু প্রতীক দিয়ে সুইং ও নতুন ভোটারদের মন জয় করা সম্ভব নয়।
সদ্য সমাপ্ত ছয়টি উপনির্বাচন নিয়ে ভোটার এবং অন্যদের মধ্যে কোনো উত্তাপ দেখা না গেলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ এবং বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-উত্তর সময়ে যথেষ্ট উত্তাপ ছড়িয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া একজন দলছুটকে, যদিও তিনি দৃশ্যত স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন, যেভাবে সরকারি দলের সার্বিক প্রচেষ্টা এবং তত্ত্বাবধানে ভোট হয়েছে, সে ধরনের নির্বাচনও এই প্রথম প্রত্যক্ষ করা গেল। ধারণা করি ভবিষ্যতে আমরা হয়তো বিভিন্ন দলছুটকে হয় অন্য কোনো নতুন দল অথবা স্বতন্ত্রভাবে বহু সুবিধা নিয়ে নির্বাচন করতে দেখব। এখানে ভোট নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমস্যা না হলেও এটাকে ‘নিয়ন্ত্রিত ভোট’ বলা যেতে পারে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই নির্বাচন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নিরুত্তাপ এই ছয় উপনির্বাচন নিয়ে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ তেমন গুরুত্ব দিয়ে মাথা ঘামাত না, যদি না বগুড়া-৪ আসনে আশরাফুল হোসেন আলমের অধিক পরিচিত ‘হিরো আলম’ সামান্য ভোটের ব্যবধানে একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে পরাজিত না হতেন। এ হারকে হিরো আলম মানতে পারছেন না। অনেক কেন্দ্রে এগিয়ে থেকেও তিনি চূড়ান্ত ফলাফলে কয়েক শ ভোটে হেরেছেন। তিনি আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন।
তবে তিনি যদি সব কেন্দ্র থেকে তাৎক্ষণিক গণনার পর আইন মোতাবেক ভোটের খতিয়ান না পেয়ে থাকেন এবং পেয়ে থাকলে ওই যোগফলে যদি চূড়ান্ত প্রকাশিত ফলাফলের সঙ্গে তফাত না হয়, তবে আইনিভাবে তিনি তেমন প্রতিকার পাবেন বলে মনে হয় না। কারণ, ভোট ইভিএমে হয়েছে এবং ভোট প্রদানে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় ইভিএমের পুনর্গণনায় ফলাফলে তারতম্য হওয়ার কথা নয়। এটাই ইভিএমের অন্যতম দুর্বলতা যে একবার ফলাফল গণনা হলে সেখানে কারিগরি বা ভোট চুরি ধরা সম্ভব নয়, যা কাগজের ব্যালটে সম্ভব।
হিরো আলমের নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, তাঁর উত্থানের মাধ্যমে যে দু-একটি বার্তা পাওয়া গেছে, তার একটি হচ্ছে পুরোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটাররা একধরনের প্রতিবাদী ভোট দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অন্য বার্তাটি হচ্ছে, শুধু প্রতীক দিয়ে সুইং ও নতুন ভোটারদের মন জয় করা সম্ভব নয়।
নির্বাচন কমিশনের সামনে আগামী নির্বাচন শুধু জটিলই নয়, নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এসবের আলামত মাত্র শুরু হয়েছে। শর্ত পূরণ না করায় নির্বাচন কমিশনের তরফে ‘তৃণমূল বিএনপি’ নামের একটি নতুন দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
এই একই দল আগেও নিবন্ধনের শর্ত পূরণ না করায় নিবন্ধন পায়নি। দলটি নির্বাচন কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে আদালত শুধু নিবন্ধনই নয়, তার পছন্দমতো মার্কা দিতেও নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, দলটি যদি নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করে না থাকে এবং নির্বাচন কমিশন যদি দলটিকে নিবন্ধনযোগ্য মনে না-ই করে থাকে, তাহলে সেই বিষয়টি কি তারা আদালতে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছে? অবস্থাদৃষ্টে তা পেরেছে বলে মনে হয় না।
সে কারণেই নিবন্ধন দেওয়ার পক্ষে রায় এসেছে। এখানে সম্পূর্ণভাবে কমিশনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। কমিশনের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে কারণ, নির্বাচনের আগে প্রায় ১০০ নতুন দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি দল আছে, যেগুলো বহুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সোচ্চার এবং দৃশ্যমান রয়েছে।
এমন কিছু দলকেও কমিশন নিবন্ধনযোগ্য মনে করেনি এবং এদের কয়েকটি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কমিশন কি নিজ উদ্যোগে নিবন্ধন দেবে, নাকি আদালতের রায়ের অপেক্ষায় থাকবে?
এ প্রসঙ্গগুলো তোলা হলো এই কারণে যে আগামী নির্বাচন শুধু জটিল ও কঠিন নয়, নির্বাচন কমিশনের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কতখানি প্রস্তুত, তা এখন থেকেই সাধারণ জনগণ, ভোটার ও অন্য শরিকদের পর্যবেক্ষণে থাকবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
hhintlbd@yahoo.com