মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবন করলে কেউ মারা যায় না। কথাটি আগেও বলার চেষ্টা করেছি, লিখে পাঠিয়েছি, কিন্তু কেউ ছাপাননি। সংগত কারণ আছে নিশ্চয়। কিছুদিন আগে ঢাকায় ১৬ মাসের একটি শিশু অসুস্থ হয়ে বমি করছিল। তার জন্য বাবা ফার্মেসি থেকে তিনটি সিরাপ এনে খাওয়ালেন। শিশুটির বমি কমল না। হাসপাতালে নেওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়ে গেল। তার বাবা ঘরে এসে দেখলেন, ভিটামিন সিরাপটি মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। ফার্মেসির লোকজন ভয়ে পলাতক হলেন। মানুষের ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও দুঃখ চারদিকে ছড়িয়ে গেল। হবেই তো। আসলে মৃত্যুর কারণটি কী ছিল, আমাদের চিন্তা করা দরকার।
আমরা জানি, ১৯৯০ সালে ও পরে বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর শত শত শিশু অজানা কারণে জ্বর হওয়ার পর কিডনি নষ্ট হয়ে কয়েক মাসের মধ্যে মারা গেল। ১৯৮২ সাল থেকে শিশু হাসপাতালের কিডনির চিকিৎসক হানিফের এ বিষয়ে নজরে আসে।
১৯৯০ সালে তাঁর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে তাদের অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল না। শিশুদের প্যারাসিটামলকে সুস্বাদু করার জন্য সাধারণত নিরাপদ জেনে প্রোপাইলেনে গ্লাইকল নামে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়।
দাম কম থাকায় মুনাফা বাড়ানোর জন্য একই স্বাদের, কিন্তু প্রমাণিত কিডনি ও লিভারের জন্য বিষাক্ত ডাইথাইলিন গ্লাইকল ব্যবহার করা হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বেশ আগে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস ও নাইজেরিয়াতে ঘটেছিল। ইদানীং ভারতের বেশ কিছু কোম্পানির এই ভেজাল ওষুধে শিশুমৃত্যুর ঘটনা এখনো ঘটছে।
তাই শিশুটির মৃত্যুর জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধকে দায়ী করা ঠিক হবে না।
আমার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে পাস করে আমাদের মতো যুক্তরাষ্ট্রে না এসে সে বগুড়ায় মানুষের সেবার জন্য চলে যায়। গরিবদের বিনা মূল্যে চিকিৎসার পাশাপাশি সে একটি ফার্মেসিও দেয়। একদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তার ফার্মেসিতে এসে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ দেখে জরিমানা তো করেনই, তাকে অপমান করে লাথি মারেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার এই অপমান দেখে আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। কেউ সেটি তখন ছাপেনি। আজ আবার সেই ঘটনা লিখতে বসলাম।
অনেকেই কিছু খাবার, যেমন প্যাকেটজাত দুধ, টিনের কৌটার খাবার, মাংস ইত্যাদির তারিখ মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা নষ্ট হয়েছে কি না, পরীক্ষা করেন এবং খাওয়া থেকে বিরত হন। সবাই জানেন, এগুলো খাওয়া অবশ্যই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেলে তা কি ক্ষতিকর হয়, এটি অনেকেই জানেন না।
আসলে খুব কম ওষুধই মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ক্ষতিকর হয়। বেশির ভাগই কোনো ক্ষতি করে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কেমিক্যালের পরিবর্তন হলে তাদের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে, কিন্তু বিষাক্ত হয় না। তবে কার্যকারিতা হ্রাস হলে তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যেমন মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কম হলে কঠিন ইনফেকশনে তা কাজে লাগবে না। তা ছাড়া আরও কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে কার্যকারিতা কম হলে ক্ষতি করতে পারে। যেমন রক্তকে পাতলা রাখার কিছু ওষুধ, অ্যালার্জির কিছু ওষুধ, অ্যাজমার ইনহেলার, ডায়াবেটিসের ইনসুলিন, হার্টের ব্যথার নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট, থাইরয়েডের ওষুধ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে আপৎকালে নতুন ওষুধ না থাকলে অবশই এগুলো নিতে হবে। না নেওয়ার চেয়ে কম কার্যকর ওষুধ অনেক শ্রেয়।
বাংলাদেশসহ সব দেশেই এ অপচয় বন্ধ করার জন্য একটি সাহসী ও মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার হয়ে পড়েছে। কীভাবে সেটি করা যাবে, তা সরকার ও বিশেষজ্ঞরা চিন্তা করবেন। নিজেদের সচেতনতা বাড়ালে ভয়ভীতি ও অপচয় কম হবে। তা ছাড়া আমাদের সাধারণ মানুষ আর গ্রামগঞ্জের ফার্মেসিতে ভেজাল বা নকল ওষুধ না কিনে যদি ভালো কোম্পানির মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিনতে পারে, তাহলে অনেক গরিব মানুষ বেঁচে যাবে। আর অপমান ও বেআইনি হওয়ার প্রয়োজন হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংস্থা ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ১৯৭৯ সালে আইন পাস করল। তাতে প্রস্তুতকারকদের সব ওষুধের—সেটা প্রেসক্রিপশন হোক বা দোকানের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই হোক—মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখের একটি গ্যারান্টি লিখে দিতে হবে, যেন তার পরে খেলে সেটির মান আর পূর্ণ কার্যকারিতা না-ও থাকতে পারে। কিন্তু ওষুধ কোম্পানির জন্য সেটি দেওয়া অসম্ভব।
কারণ,তাদের পক্ষে প্রতিটি ওষুধ কে কত দিন কী পরিবেশে রেখেছে এই পরীক্ষা করা সম্ভব নয় এবং তা করতে হলে বহু বছর সময় লাগবে এবং সময়মতো জরুরি ও নতুন ওষুধগুলোর জন্য সরকারি অনুমোদন পাওয়া যাবে না। তাই তারা মেয়াদোত্তীর্ণের জন্য একটি সময়সীমা নিজেদের ব্যবসার সুবিধার্থে কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছাড়াই নির্ধারণ করেছে। কিছু ওষুধ অবশ্য আসল প্যাকেট থেকে খুলে ফেললে মেয়াদের তারিখ একটু আগেই উত্তীর্ণ হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোয় কম করে হলেও ৮০০ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে ফেলে দেওয়া হয়। তা ছাড়া ফার্মেসি, অন্য ক্লিনিক, নার্সিংহোম ও মানুষের বাড়ি থেকে অনেক ওষুধ প্রতিবছর ফেলে দেওয়া হয়।
সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হয়েছে, অনেক জরুরি ওষুধ সরবরাহ কম থাকায় হাসপাতালে মাঝেমধ্যে ঘাটতি পড়ে এবং বিপদ ডেকে আনে।
তবে ২০০৬ সালে এফডিএ তাদের জরুরি সময়ে জাতীয় ইমার্জেন্সির জন্য বিশাল মজুতভান্ডারে রাখা অনেক ওষুধ মেয়াদ পরীক্ষা করে কম করে হলেও পাঁচ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারের স্পেশাল পারমিশন আছে, তাই তারা মিলিটারি, সেন্টার ফর ডিসিজ কন্ট্রোল এবং ভেটেরান বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাসপাতালে তা অহরহ ব্যবহার করে ৬০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ অপচয় থেকে বাঁচায়।
তা ছাড়া মাঝেমধ্যে ওষুধ কোম্পানিগুলোও জীবন বাঁচানোর জরুরি কিছু ওষুধের ঘাটতি পূরণ করার জন্য মেয়াদ শেষ হলেও তা বাড়ায়।
একটি নয়, অনেক পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ অনেক দিন ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতি হয় না। সবচেয়ে বড় গবেষণা করেছে এফডিএ। তারা মার্কিন মিলিটারিদের তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১০০ শ ওষুধ পরীক্ষা করে দেখেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ১৫ বছর পরও ৯০ শতাংশ ওষুধ কার্যকর ও নিরাপদ রয়েছে। তবে কিছু ওষুধ, যেমন ইনসুলিন, নাইট্রোগ্লিসারিন এবং তরল বা লিকুইড অ্যান্টিবায়োটিক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে কাজ না-ও করতে পারে।
দুঃখের বিষয়, এত কিছু জানার পরও কিন্তু সেটা সাধারণ জনগণ, ফার্মেসি ও হাসপাতালের জন্য প্রযোজ্য নয়। সরকারি ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের সংস্থা আইন করে ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখা বেআইনি ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া সব হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জয়েন্ট কমিশন সব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ হাসপাতালে রাখলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ২০০০ সালে বিবৃতিতে এ আইনকে পরিবর্তন করে ওষুধের মেয়াদ আরও ন্যায়সংগতভাবে বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে, যাতে ওষুধের মূল্য কমানো যায়, স্বাস্থ্য খাতের অনেক অপচয় কমে এবং মানুষ সহজে জরুরি ওষুধ সময়মতো পেতে পারে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের লোভ ও রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক নীতি বারবার এ উদ্যোগকে আটকে দিয়েছে।
তাই বাংলাদেশসহ সব দেশেই এ অপচয় বন্ধ করার জন্য একটি সাহসী ও মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার হয়ে পড়েছে। কীভাবে সেটি করা যাবে, তা সরকার ও বিশেষজ্ঞরা চিন্তা করবেন। নিজেদের সচেতনতা বাড়ালে ভয়ভীতি ও অপচয় কম হবে। তা ছাড়া আমাদের সাধারণ মানুষ আর গ্রামগঞ্জের ফার্মেসিতে ভেজাল বা নকল ওষুধ না কিনে যদি ভালো কোম্পানির মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিনতে পারে, তাহলে অনেক গরিব মানুষ বেঁচে যাবে। আর অপমান ও বেআইনি হওয়ার প্রয়োজন হবে না।
কোন ওষুধ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, সে সম্পর্কেও সবার জানা দরকার। ফার্মাসিস্টরা বলতে পারেন কোন ওষুধ কীভাবে রাখা দরকার। যেমন কিছু ওষুধ রেফ্রিজারেটরে রাখতে হবে। এর বাইরে সব ওষুধই আসলে কোনো অন্ধকার জায়গায়, যেখানে গরম বা আর্দ্রতা কম থাকবে, সেখানে রাখা দরকার। অনেকে বাথরুমে ওষুধ রাখেন, সেটি একেবারে ঠিক নয়। তা ছাড়া শিশুরা এবং ঘরের কুকুর-বিড়ালও যেন ওষুধের নাগাল পেতে না পারে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রেসক্রিপশন ছাড়া দোকান থেকে কেনা বেশির ভাগ ওষুধ, যেমন টাইনেল বা অ্যাসিটামিনোসিন, প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন, অ্যালার্জি-সর্দিকাশির ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও নেওয়া যেতে পারে।
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলো যদি ফেলেই দিতে হয়, তাহলে কখনো টয়লেটে ফেলা যাবে না। কারণ, সেগুলো শহরের পানি ও বর্জ্য পরিশোধনে বিঘ্ন ঘটায়। ওষুধগুলো ট্র্যাশ করে দেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রে এফডিএ কর্তৃক ওষুধ ফেলার নির্ধারিত দিন ও স্থান নির্ধারণ করা আছে।
জিয়াউদ্দিন আহমদ অধ্যাপক, মেডিসিন ও কিডনি বিভাগ, টেম্পল ইউনিভার্সিটি, ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র