মতামত

চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে বিসিএসে শর্ত কেন

চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, একজন প্রার্থী বিসিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ তিনবারের বেশি অংশ নিতে পারবেন না।

আন্দোলনকারীদের কাঙ্ক্ষিত ৩৫ বছরের দাবি পূরণ না হওয়ায় তাঁরা সরকারের এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ ও হতাশা। চাকরিপ্রার্থী অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করে হতাশা ও ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় তিনবারের বেশি অংশ নেওয়া যাবে না—এমন কেন শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে জোর আলোচনা।

‘চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী সাধারণ শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ’-এর আহ্বায়ক শরিফুল হাসান বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত তাঁরা যে দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সরকারি সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি। আন্দোলনকারী সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শর্ত বাদ দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৫ বছর করতে হবে।

২.

ছয়বার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন রাশেদুল হাসান নামের এক যুবক। ৩৫তম থেকে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেছিলেন তিনি। ৩৫,৩৬, ৩৮ ও ৪০তম বিসিএসে হন নন-ক্যাডার; আর জীবনের শেষ ৪১তম বিসিএসে অংশ নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে (ইংরেজি) প্রথম হন রাশেদুল (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো অনলাইন, ৬ আগস্ট ২০২৩)।

রাশেদুলের উদাহরণ টেনে কেউ কেউ বলছেন, তাহলে কেন তিনবার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার পর একজন চাকরি প্রার্থীকে কর্তৃপক্ষ থামিয়ে দেবে? বয়স যত দিন থাকবে অন্যান্য চাকরির মতো বিসিএস দেওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত রাখতে হবে।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তে অনেক প্রশ্নই সামনে আসে। যাঁরা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে আন্দোলন করে আসছেন, তাঁদের অনেকের বয়স ৩২ বছর পার হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তাঁদের কী লাভ হলো?

আবার যদি চাকরির বয়স বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা হয়, তখন ছেলেমেয়েরা প্রত্যাশিত চাকরির পেছনে যদি ৩৫ বছর পর্যন্ত ছোটেন, তবে তাঁরা ঘর-সংসার কবে পাতবেন? পরিবার, সংসার, সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করবেন কখন—এসব বিষয় নিয়েও কথা হচ্ছে।

৩.

কিছুদিন আগে পর্যালোচনা কমিটি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিল। সেই সুপারিশে নারীর চাকরির বয়সসীমা ৩৭ বছর ও পুরুষের ৩৫ বছর করা হয়। যে বৈষম্যের জন্য এত লড়াই-সংগ্রাম, সেই বৈষম্য রেখেই সুপারিশ করা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। বয়সসীমা সবার একই হওয়ার পক্ষেই দাবি ওঠে। শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষ সবার জন্য একই বয়সসীমা নির্ধারণ করায় স্বস্তি ফিরলেও ৩৫–এর দাবি থেকে সরে আসেননি আন্দোলনকারীরা।

অবশ্য সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ানোর দাবি নতুন নয়। এক দশকের বেশির সময় আগে থেকে চাকরিপ্রার্থীরা এই দাবি জানিয়ে আসছিলেন। দাবির পক্ষে প্রথম যাঁরা রাজপথে আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকের বয়স এখন ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। সুতরাং এখন চাকরির বয়স ৩৫ বছর করা হলেও তাঁরা কোনো সুবিধা পাবেন না। তাই কারও কারও চাওয়া চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেওয়া হোক।

৪.

নতুন বাংলাদেশে দুই বছর চাকরির বয়স শুধু বাড়ালেই চলবে না। বেকার তরুণ-তরুণীদের ব্যথা-বেদনা উপলব্ধি করে সরকারি চাকরির আবেদন ফি কমাতে হবে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরিপ্রার্থীরা বহুবার আবেদন ফি কমানোর দাবি জানিয়েও কোনো ফল পাননি। তাই হতাশ হয়ে সেই দাবির বিষয়ে চুপ হয়ে গেছেন। তাঁরা আবার সরব হওয়ার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের চাকরির পরীক্ষার ফি কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

বর্তমানে বিসিএসের আবেদন ফি ৭০০ টাকা। নবম গ্রেড বা এর বেশি গ্রেডভুক্ত (নন-ক্যাডার) পদে আবেদন ফি ৬০০ টাকা, দশম গ্রেডের পদে আবেদন ফি ৫০০ টাকা, ১১ থেকে ১২তম গ্রেডের জন্য ৩০০ টাকা, ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডের জন্য ২০০ টাকা এবং ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের জন্য ১০০ টাকা। যা বেকার যুবকদের জন্য যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এমন বর্ধিত ফি কমাতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে বেকার যুবকদের বোঝা কমানোর।

নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাকরির পরীক্ষার ফি কমানো, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার বিষয়ে সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

  • তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
    ই-মেইল: towhidul. islam@prothomalo. com