আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন তালেবান প্রশাসন গত ১৮ মে ঘোষণা করেছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দের স্থলে তাঁর ডেপুটি মৌলভি আবদুল কবিরকে বসিয়েছে।
তাদের ভাষ্যমতে, আখুন্দ অসুস্থ থাকায় দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। ২০২০ সালে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে সমঝোতা হয়েছিল, তাতে আবদুল কবির অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। কবিরের এই নিয়োগকে তালেবান সরকারের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে দাবি করা হলেও নিয়োগের সময়কালটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমকে এই বিষয়টি খুবই সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
শিক্ষায় মেয়েদের অন্তর্ভুক্তিকে সীমিত করে আনা এবং বিভিন্ন পেশায় মেয়েদের অংশগ্রহণকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে তালেবান প্রশাসন যখন আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে, ঠিক সেই সময়ে এই ঘোষণা এল। নেতৃত্বের এই পরিবর্তনকে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি ও তালেবানের আরও দরাজ হওয়ার একটি আভাস হিসেবে দেখা যেতে পারে।
তালেবানের অবস্থান থেকে সরে আসার পথে হয়তো তাদের অহংবোধ থেকে যাবে, কিন্তু তাঁরা যে ছোট ছোট পরিবর্তন আনছে, তা পরিবর্তনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যেমন তালেবান সম্প্রতি হেরাতে মেয়েদের কয়েকটি মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালুর অনুমতি দিয়েছে। আবদুল কবির শিগগিরই মানবিক কার্যক্রমে মেয়েদের কাজ করার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারেন। কারণ, তালেবান কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য খাত ও প্রধান প্রধান এনজিওর ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।
পশ্চিমাদের উচিত তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। একই সঙ্গে উন্নয়ন সহায়তার বিষয়টি ক্রমে পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব যে প্রস্তুত আছে, তা আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে স্পষ্ট করা দরকার। গত কয়েক দশকের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকট এবং এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলার মতো একটি সম্ভাব্য সংঘাত প্রতিরোধ করতে এই ধরনের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর আগে তালেবান যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তখন বিদেশিরা সেই সুযোগটি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই একই ভুল এবার তাদের করা উচিত হবে না। তালেবানের এই কৌশলগত পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কয়েকটি পয়েন্ট বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
প্রথমত, তালেবানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যাবে, ২০২১ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখুন্দের নিয়োগ ছিল অবশ্যম্ভাবী। তাঁর নিয়োগকে সাবেক (১৯৯৬ থেকে ২০০১) তালেবান শাসনের ধারাবাহিকতার প্রতীক হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা তালেবানের সামনে দেশের ভেতরে গুরুতর কোনো বিরোধী শক্তি নেই। হয়তো সে কারণেই তারা বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিসর তৈরি করতে আগ্রহী হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, গত দুই বছরে বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার সুবাদে তালেবান নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে, পরস্পর সংযুক্ত আজকের দুনিয়ায় নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের ধারণা অবাস্তব। বিশেষ করে, মানবিক সংকটের মধ্যে বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে দেশ চালানো খুবই দুরূহ।
তৃতীয়ত, তালেবান সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত অনমনীয় থাকার যে নীতি এত দিন অনুসরণ করে এসেছে, তা থেকে তাদের সরে এসে উদার নীতি সম্প্রসারণের দিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। কবিরের নিয়োগ সে আভাসই দিচ্ছে। তালেবানের নতুন নীতিতে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আলোচনার ক্ষেত্র উন্মুক্ত রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।
কবিরের নিয়োগের মধ্য দিয়ে তালেবান স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে এবং বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মিশতে চায়। আন্তর্জাতিক নেতাদের এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
পশ্চিমাদের উচিত তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। একই সঙ্গে উন্নয়ন সহায়তার বিষয়টি ক্রমে পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব যে প্রস্তুত আছে, তা আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে স্পষ্ট করা দরকার। গত কয়েক দশকের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকট এবং এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলার মতো একটি সম্ভাব্য সংঘাত প্রতিরোধ করতে এই ধরনের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সুলতান বারাকাত কাতার ফাউন্ডেশনের হামাদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটির কনফ্লিক্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক