‘আজ যে শিশু
পৃথিবীর আলোয় এসেছে
আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।’
১৯৯৫ সালে বিটিভিতে সম্ভবত ঈদের এক অনুষ্ঠানে রেনেসাঁ ব্যান্ডের সঙ্গে তাদের এ গান গেয়েছিলেন কলিম শরাফী, নীলুফার ইয়াসমিন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা। ছিলেন জনপ্রিয় আরও সংগীতশিল্পী। এ গানের স্রষ্টা ছিলেন গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। তার এক বছর আগে রেনেসাঁর তৃতীয় বিশ্ব অ্যালবামে এ গান রিলিজ হয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বে জন্ম নেওয়া সব শিশুর জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরির আকুতি প্রকাশ পেয়েছে গানটিতে। এমন আকুতি আমরা পাই ক্ষণজন্মা সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত চরণে, ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।’
চালকেরা কেন পালিয়ে যান? গণপিটুনির ভয়ে নিশ্চয়ই। এখন মানুষ কেন গণপিটুনিকে হাতিয়ার হিসেবে নেয়? বিচারহীনতার সংস্কৃতি তো তাকে সেই পথেই ঠেলে দেবে। সেই একই কারণেও যেমন আজ দেশের সড়কগুলো হয়ে উঠেছে চলন্ত মর্গ।
তবে নির্মম পরিহাসের মতো বলতে হয়, পৃথিবীতে আসতে না আসতেই এ দেশের শিশুদের গ্রাস করছে সমূহ নিরাপত্তাহীনতা। একটি শিশুর জন্য মায়ের কোলই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তার চাদর—এই চিরসত্য নিয়েও আমাদের এখন সংশয় হতে হয়। একটি শিশুর আগমন মানেই একটি দম্পতির জন্য নতুন এক পৃথিবী দেখা। নতুন স্বপ্ন, নতুন গান। কিন্তু সেই পৃথিবী মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে যায়, সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, স্তব্ধ হয়ে যায় কণ্ঠ—যখন আমরা দেখি সড়কেই মায়ের পেট চিরে জন্ম নিতে বাধ্য হতে হয় কোনো শিশুকে।
গত শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে নীলফামারী জেলা সদরের শিমুলতলী এলাকার ঘটনা। প্রসবব্যথা নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা শারমিন আখতার হাসপাতালে যাওয়ার পথে তাঁকে বহনকারী অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয় একটি মাইক্রোবাস। অটোরিকশাকে টেনে অনেক দূরে নিয়ে যায় সেটি। এ সময় রিকশা থেকে সড়কে ছিটকে পড়েন অন্তঃসত্ত্বা। সেখানেই একটি মেয়ে নবজাতকের জন্ম হয়। সেখানেই মারা যান মা–মেয়ে। এটিকে কি নিছক সড়ক দুর্ঘটনা বলা যায়? মাইক্রোবাসটির চালক দ্রুত গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করলে হয়তো মা–মেয়ের জীবন বেঁচে যেত। কিন্তু গাড়িচালক পালিয়ে যাবেন, পালিয়ে যাওয়ার আগে আহত মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করে যাবেন, এটিই যেন নিয়ম হয়ে গেছে এ দেশে।
নবজাতকটির আর মায়ের কোলে ঘুমানো হলো না, মায়ের সঙ্গে কবরেই ঘুমিয়ে গেল। শারমিনের স্বামী রেজাউল ইসলাম সৈয়দপুর শহরে দরজির কাজ করেন। তাঁদের চার বছরের একটি মেয়ে আছে। দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম ঘিরে পরিবারটিতে উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। দরজি রেজাউল হয়তো কত শিশুর জামাকাপড় বানিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু কোনো নাম পাওয়ার আগেই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া শিশুর জন্য তাঁর আর জামা বানানো হলো না।
ময়মনসিংহের ত্রিশালের শিশুর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। কারণ, সে একটি নাম পেয়েছে—ফাতিমা। রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান তার কৃষক বাবা আর অন্তঃসত্ত্বা মা। সেখানেই রাস্তার ওপর মায়ের পেট চিরে বের হয়ে এসেছিল ফাতিমা। এ কেমন ‘ছাড়পত্র’! দৃশ্যটি কল্পনা করলে ভারতের দক্ষিণি সিনেমাকেও হার মানায় যেন এ ঘটনা।
জন্ম নিয়েই পৃথিবীর যে নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার শিকার হলো এই নবজাতক, সেটিই যেন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তার স্তম্ভিত ছবিতে দেখা গিয়েছিল। অথচ জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে নতুন বিশ্বের দ্বারে যার অধিকার ব্যক্ত করার কথা। ‘ভূমিষ্ঠ শিশুর অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে’ কী এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে পেলাম! কথা ছিল, ‘তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত’ হবে ‘কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়’; সেই হাতই ভেঙে গিয়েছিল তার, ব্যান্ডেজে মোড়ানো সেই হাতের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন বেশ আলোড়ন তুলেছিল।
এই মৃত্যুগুলোর জন্য মোটাদাগে অনেকগুলো কারণ দায়ী, সেসব কারও অজানা নয়। সেখানে রাস্তা পার হওয়া নিয়ে জনসাধারণের অসচেতনতার বিষয়টিও সত্য। কিন্তু সেটিকেই যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে, তাতে আমরা হতাশ হই। মহাসড়ক বা আঞ্চলিক সড়কগুলোতে কেন অটোরিকশা বা রিকশাভ্যান চলবে, সেই দায় তাহলে কেউ নেবে না?
কোনো গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বা পুনরায় ফিরে এসে আবারও পিষে দেওয়ার কারণে সড়কে কত মৃত্যু হচ্ছে, সেই পরিসংখ্যান হয়তো কোথাও পাওয়া যাবে না, কিন্তু এমনটি দেখতে দেখতে বা খবরের কাগজে পড়তে পড়তে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
কিন্তু চালকেরা কেন এমন করেন? গণপিটুনির ভয়ে নিশ্চয়ই। এখন মানুষ কেন গণপিটুনিকে হাতিয়ার হিসেবে নেয়? বিচারহীনতার সংস্কৃতি তো তাকে সেই পথেই ঠেলে দেবে। সেই একই কারণেও যেমন আজ দেশের সড়কগুলো হয়ে উঠেছে চলন্ত মর্গ। আর মর্গের দারোয়ান তো তাঁরাই, যাঁরা আইন করেও সেই আইনকে অকেজো করে রাখেন। ক্ষমতার নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে থাকেন তাঁরা, তাঁদের সন্তানেরা, তাঁদের পরিবার। আর আমাদের সন্তানেরা আমাদের শিশুদের পৃথিবীর আলো–বাতাস গায়ে লাগার আগেই পরপারে পাড়ি দিতে হয় কিংবা এতিম হয়ে যেতে হয়।
একদা স্বাধীন বাংলা বেতারে বেজেছিল গান—যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে/ সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে শপথ করি। সেই শিশুর মায়া হাসির আর শান্তির শিবির আজও দুরাশাই থেকে গেল। সাধারণ মানুষকে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থেকে ফেরাতে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বা শপথ আজ বড় জরুরি, তা আজ ঘুণপোকায় আক্রান্ত।
● রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী