মতামত

বিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানির নিরাপত্তাহীনতা বাড়াচ্ছে ভূরাজনীতি

ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে
ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত দুটি খাতের পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একটি হলো খাদ্য এবং অপরটি জ্বালানি। এই সংঘাতে খাত দুটির নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক চাপ পড়েছে। কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূরাজনৈতিক সংঘাতের মতো নেতিবাচক শক্তির সম্মিলিত চাপ বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তাকে কোণঠাসা করেছে। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পর্যবেক্ষণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সমস্ত প্রাত্যহিক ব্যবহার্য নিত্যপণ্যের দাম বিভিন্ন হারে বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তেলের দাম আগের এক বছরের তুলনায় ৬৭.৬ শতাংশ বেশি ছিল। একইভাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম একই সময়ে ২০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অ্যালুমিনিয়ামের দাম গত ১৫ বছরের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং খাদ্যের দামও একইভাবে বাড়ছে। অন্যদিকে গমের মতো পণ্যের দামও সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত খাদ্যের গড় মূল্য বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১.৮ শতাংশ বেড়েছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখছে। এই সংঘাত নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর পাশাপাশি কোভিড মহামারির ছোবলে আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় তড়পাতে থাকা দুর্বল সম্প্রদায়গুলোর চ্যালেঞ্জকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রতি মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে প্রায় ৬০ লাখ টন কৃষিপণ্য পাঠানো হতো। ২০২২ সালের জুনে এই পরিমাণ তার পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে, যা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের একটি বড় কারণ। সংস্থাটি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, খাদ্যের দাম ও সরবরাহের ওপর ইউক্রেনের সংঘাত পরিস্থিতি যে প্রভাব ফেলেছে, শুধু সেই প্রভাবের কারণেই অপুষ্টিতে ভোগা লোকের সংখ্যা ৭৬ লাখ থেকে ১ কোটি ৩১ লাখে উঠে যাবে।

বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) গ্রুপের দেশগুলো; বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার ও ভুটান জ্বালানি আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। জ্বালানির ওপর অতিমাত্রার নির্ভরশীলতা এই অঞ্চলকে তাৎপর্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এটি এই অঞ্চলকে বহিরাগত অর্থনৈতিক ব্যাঘাত সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলের অধিকতর জ্বালানি স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।

এই যুদ্ধের কারণে উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা জ্বালানিমূল্য বহু উন্নয়নশীল দেশকে মূল্যস্ফীতির চাপে ফেলে দিয়েছে। যদিও প্রভাবগুলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে আটকে রাখার মতো যথেষ্ট বলশালী নয়, তথাপি এগুলো বৈশ্বিক ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিতে এবং উন্নয়নকে ঝুঁকিতে ফেলতে সক্ষম। সে কারণে বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানি ঝুঁকির খারাপ প্রভাব মোকাবিলায় সম্মিলিত উপায়ের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারগুলো বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে উল্লেখযোগ্য অস্থিরতার উৎসে পরিণত হয়েছে। যেহেতু বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো অপরিশোধিত তেল বেচে অর্থ উপার্জন করে না বরং তেল কিনতে গিয়ে তাদের প্রচুর অর্থ ঢালতে হয়, সে কারণে বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোর নীতিগতভাবে এটি নিশ্চিত করা উচিত যে তেলের বাজার ওঠানামার খেসারত এই ধরনের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দিতে হবে না। 

সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই, মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ও ঘনবসতির জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নিতে হবে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত বিশ্বের নাজুক জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একইভাবে আফ্রিকান ও দক্ষিণ এশিয়ার নির্দিষ্ট কিছু দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথকে প্রসারিত করতে আন্তর্জাতিক সহায়তাকে অধিকতর কৃষিভিত্তিক করা দরকার।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে বিশ্বকে খাদ্য সরবরাহের সামর্থ্য অর্জনের সম্ভাবনা আছে; কিন্তু তারা তা তো পারছেই না, বরং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে তাঁদের খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এ কারণেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে সঙিন অবস্থার মুখে পড়া বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোতে জলবায়ু সহনীয় স্মার্ট কৃষি এগিয়ে নিতে সেখানে বাড়তি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। পানি-খাদ্য-জ্বালানির পারস্পরিক যোগসূত্রকে আমলে নিয়ে পানির সহজপ্রাপ্যতা ও পুষ্টি সুরক্ষায় একটি সমন্বিত পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

একইভাবে, আন্তর্জাতিক বাজারগুলো বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে উল্লেখযোগ্য অস্থিরতার উৎসে পরিণত হয়েছে। যেহেতু বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো অপরিশোধিত তেল বেচে অর্থ উপার্জন করে না বরং তেল কিনতে গিয়ে তাদের প্রচুর অর্থ ঢালতে হয়, সে কারণে বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোর নীতিগতভাবে এটি নিশ্চিত করা উচিত যে তেলের বাজার ওঠানামার খেসারত এই ধরনের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দিতে হবে না। 

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

সৌম্য ভৌমিক ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন-এর সেন্টার ফর নিউ ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির একজন সহযোগী ফেলো। তাঁর গবেষণার বিষয় বিশ্বায়ন অর্থনীতি, ভারতীয় অর্থনীতি ও শাসন এবং টেকসই উন্নয়ন