২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ইরানে বিদ্যমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে। মূলত কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের আনা এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ২৩টি। বিপক্ষে ৮টি এবং ১৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
বাংলাদেশ সে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য যেসব দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ও ইরানের পক্ষে ভোট দেয়, সেসব দেশ হচ্ছে বলিভিয়া, চীন, কিউবা, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম। মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশ কোন ক্লাবে যোগ দিয়েছে, এই তালিকা অনেকটা স্পষ্ট আভাস দেয়। ভোটদানে বিরত দেশগুলোর মধ্যে ছিল ভারত, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইরানের প্রতি একধরনের সহমর্মিতা আছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের সময় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এমনকি বাম চিন্তাধারার ছাত্রদের মধ্যেও চরম ডান এবং নির্যাতনকারী রেজা শাহর পতনে ইরানি বিপ্লবের প্রতি একধরনের সমর্থন দৃশ্যমান ছিল।
পরবর্তীকালে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আবুল হাসান বনিসদরকে খোমেনি কর্তৃক বরখাস্তকরণ, প্রাণরক্ষায় তাঁর দেশ থেকে পলায়ন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাদেক কুতুবজাদেহকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মাধ্যমে বিপ্লব–পরবর্তী ইরানের প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হয়।
একপর্যায়ে সেখানে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হয়ে ওঠেন আয়াতুল্লাহ সাদেক খালখালি, যিনি সারা দেশে ঘুরে ঘুরে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের পাইকারি হারে মৃত্যুদণ্ড দিতে থাকেন। যেকোনো ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যা হয়, ইরানের এ পশ্চাদ্যাত্রায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী সমাজ। পর্বতপ্রমাণ সমস্যায় নিমজ্জিত দেশটির এ সপ্তাহের অগ্রাধিকার, মেয়েরা হিজাব আইন ঠিকমতো মানছে কি না, তা মনিটর করতে জনসমাগম হয়, এমন সব স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন!
অনেক দিন থেকেই ইরানের পরিস্থিতি মানবাধিকার কাউন্সিলের অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। নিকট অতীতে ২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর মানবাধিকার কাউন্সিল এস৩৫/১ নম্বর প্রস্তাব পাস করে। যার শিরোনাম ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানে ক্রমাবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষত নারী ও শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে। প্রস্তাবে একটি স্বাধীন তথ্যানুসন্ধান মিশন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার কাজ হবে ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ইরানে শুরু হওয়া বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশেষত নারী ও শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অনুসন্ধান; এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পর্যালোচনা এবং ইরান সরকার, সিভিল সমাজ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ।
প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ২৫-৬ ভোটে—১৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে (বাংলাদেশ তখন মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য ছিল না)। ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের সারা হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তথ্যানুসন্ধান মিশন নিয়োগ করে। মিশনের অন্য দুই সদস্য নিযুক্ত হন পাকিস্তানের শাহীন সরদার আলী এবং আর্জেন্টিনার ভিভিয়ানা ক্রিস্টিসেভিচ। মিশনকে জুন-জুলাই ২০২৩-এর মধ্যে মৌখিক আপডেট এবং ২০২৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠেয় মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৫তম অধিবেশনে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদানের অনুরোধ করা হয়।
ইউরোপে কর্মরত আমাদের রাষ্ট্রদূতেরাও বেশ বিড়ম্বনার সম্মুখীন হবেন, তা অনুমান করা যায়। আমাদের দেশের অনেকে মানবাধিকার প্রশ্নে পশ্চিমাদের পক্ষপাতদুষ্ট দ্বৈতনীতির সমালোচনা করেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ হয়তো সঠিক, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর কাজকর্মের মূল্যায়ন ও বিচারের ক্ষমতা বা যোগ্যতা আমাদের নেই। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার স্বার্থের বিবেচনায়, অন্য কিছুতে নয়।
দেশভিত্তিক (কান্ট্রি স্পেসিফিক) ইস্যুতে বাংলাদেশ সাধারণত কোনো পক্ষ নেয় না। তবে এটা অবশ্যপালনীয় কিছু নয়। ইরানের পক্ষে দেওয়া ভোট এই নীতির ব্যত্যয় বলা যেতে পারে। তবে এমনটি আগেও বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে। মানবাধিকার কাউন্সিল ২০২১ সালের ১২ জুলাই ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার’ শীর্ষক প্রস্তাব নম্বর এ/এইচআরসি/৪৭/এল.১১ (A/HRC/47/L.11) পাস করে।
প্রস্তাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনে প্রবল নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। পরিস্থিতি নিরসনে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কান্ট্রি স্পেসিফিক প্রস্তাবটি কোনো ভোটাভুটি ছাড়াই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
কিন্তু যদি ভোট হতো প্রস্তাবের ওপর, অথবা যদি আগামীকাল এমন একটি প্রস্তাব আবার আসে ভোটে, বাংলাদেশ নিশ্চয় প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিত। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার প্রসঙ্গে কান্ট্রি স্পেসিফিক প্রস্তাব এসেছে এবং ভোট হয়েছে একাধিকবার। প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে (উদাহরণ, ড্রাফট রেজল্যুশন এ/সি.৩/৭৫/এল.৩৪, তারিখ ১৮ নভেম্বর ২০২০, এ/সি.৩/৭৪/এল.২৯, তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৯, এ/সি.৩/৭৩/এল.৫১, তারিখ ১৬ নভেম্বর ২০১৮ ইত্যাদি)।
বস্তুত, পররাষ্ট্রনীতি কোনো স্থবির বিষয় নয়। একটি বিষয়ই শুধু স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। আর তা হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। অর্থাৎ চূড়ান্ত বিচারে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে। দেখা যাক, ইরান প্রসঙ্গে আমাদের এই ভোট জাতীয় স্বার্থ কতটা
রক্ষা করছে।
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’—এ আপ্তবাক্যের আওতায় ইরান আমাদের বন্ধু। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্রও আছে। তবে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সম্পর্কের মধ্যে বাস্তব উপাদানের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। একসময় বেশ কিছু ডাক্তার কাজ করতেন ইরানে, সেটি এখন মোটামুটি অতীত। বাণিজ্যের পরিমাণও সীমিত। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও পারস্পরিক বোঝাপড়া সব সময় মসৃণ নয়। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের সমর্থন পেতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়।
পক্ষান্তরে আমাদের বিপুল স্বার্থ রয়েছে পশ্চিমে। আমাদের প্রায় সব রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকা। বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সেরও গুরুত্বপূর্ণ উৎস পশ্চিম। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও প্রায় সম্পূর্ণ সমর্থনই আসে পশ্চিম থেকেই। ইরানের পক্ষে আমাদের এই ভোট নিঃসন্দেহে তাদের অসন্তোষের কারণ হবে।
ইউরোপে কর্মরত আমাদের রাষ্ট্রদূতেরাও বেশ বিড়ম্বনার সম্মুখীন হবেন, তা অনুমান করা যায়। আমাদের দেশের অনেকে মানবাধিকার প্রশ্নে পশ্চিমাদের পক্ষপাতদুষ্ট দ্বৈতনীতির সমালোচনা করেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ হয়তো সঠিক, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর কাজকর্মের মূল্যায়ন ও বিচারের ক্ষমতা বা যোগ্যতা আমাদের নেই। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার স্বার্থের বিবেচনায়, অন্য কিছুতে নয়।
মানবাধিকার কাউন্সিলে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ইরানের পক্ষে বাংলাদেশের ভোট কোনো বিচারেই বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের অনুকূল বলে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। সে হিসেবে এই সিদ্ধান্ত ছিল অপ্রয়োজনীয় ও ভুল। ভারত বা মালয়েশিয়ার মতো কেন আমরাও ভোটদানে বিরত থাকলাম না, তার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব