একজন রাস্তার মোড়ে বাইক থামালেন জাম্বুরা কিনতে। জাম্বুরার দাম অযৌক্তিক মনে হওয়ায় তিনি মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে একনাগাড়ে বিভিন্ন দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করে বললেন, ‘এরা কেয়ামতের দিনেও কাফনের কাপড়ের দাম বাড়াইয়া দিবে।’ তারপর সেই নীতিবাক্য আওড়ানো লোকটি জাম্বুরা না কিনে রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে বাইক টেনে চলে গেলেন।
জনৈক সরকারি কর্মকর্তা একবার বিদেশে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে ওখানকার রাস্তায় শৃঙ্খলা দেখে মনপ্রাণ ভরিয়ে ঢাকার বিমানবন্দরে এসে নামলেন। বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফেরার পথে এক জায়গায় বাঁয়ের লেনে প্রচণ্ড জ্যাম থাকায় তাঁর চতুর চালক ডান দিকে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন।
দীর্ঘ বিমানভ্রমণে ক্লান্তির কারণে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার তাড়া থাকায় তিনি বিদেশে সদ্য নেওয়া প্রশিক্ষণ ও চোখজুড়ানো অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে তাঁর চালককে ডান দিকে গাড়ি ঢোকানোর সময় বাধা দেননি। ব্যস্ত রাস্তায় ফাঁক পেলে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে উঁচু স্তরের লোকজন আইন ও নীতিবাক্য ভুলে যান।
এক বয়স্ক লোক তাঁর ছেলেকে নিয়ে পাবলিক বাসে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে দেখে এক সদাশয় তরুণ নিজের সিট ছেড়ে তাঁকে বসতে দিলেন। পরের স্টপেজে বয়স্ক লোকটির পাশের সিটটি খালি হওয়ার পর তিনি তাতে যে তরুণ সিট ছেড়ে তাঁকে বসতে দিয়েছিলেন, তাঁকে না বসিয়ে নিজের ছেলেকে বসালেন।
এক প্রাইভেট কারের সঙ্গে এক বাসের আংশিক সংঘর্ষ হওয়ায় কারের মালিক বাসের পথ রোধ করে তার চালকের সঙ্গে বদানুবাদে লিপ্ত হলেন। রাস্তার মাঝখানে থেমে থাকা সেই প্রাইভেট কার ও বাসের কারণে তখন পুরো রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ।
এ রকম দৃশ্য আমরা হরহামেশা দেখি। তো সেই বাসের চালক ও প্রাইভেট কারের মালিককে থামাতে না পেরে এক বাসের চালক বললেন, দুইটাই ফাউল। তাঁর কথা শুনে এক পথচারী বললেন, তুমি আবার কোন কাননের ফুল? আমাদের এমন দ্বিচারিতা ও অকৃতজ্ঞার অসংখ্য উদাহরণ উপস্থাপন করা যাবে।
এবার আসা যাক নীতিনৈতিকতায় আমরা কতটা আপসহীন। এক লোক মদ্যপান করেন বলে তাঁর স্ত্রী প্রায়ই রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যান। আবার সেই লোক যখন ঘুষের টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দেন, তখন অর্ধাঙ্গিনী তাঁকে বলেন, তোমার একমাত্র বদভ্যাস মদ্যপানটা ছাড়ো তো।
এক নারী অন্য নারীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলছিলেন, আমার মেয়ের জামাই এখন আর ঘুষ খেতে চায় না। কিন্তু মেয়ের জন্য খেতে হয়। এ কথা বলাই যায়, মেয়ে ও জামাইয়ের মধ্যে অন্তত একজন সেই নারীর কাছে নির্দোষ। এক লাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিভিন্ন টালবাহানা ও কৌশলে তাঁর কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতি আটকানোর চেষ্টা করেন। আর অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই ব্যক্তির সন্তানের পদোন্নতি না হওয়ায় তিনি আফসোস করে বললেন, মানুষ কত খারাপ!
এখন দেখা যাক আমরা কতটা শৃঙ্খলাপ্রিয়। ভদ্রলোক চেনা যায় টিকিট কাটার লাইনে। দেখা যায় অনেক লোক ট্রেনের টিকিট কাটতে অনেকক্ষণ ধরে ধৈর্যসহ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এর মাঝে চক্ষুলজ্জাহীন কিছু লোক লাইনে না দাঁড়িয়ে কাউন্টারের মুখে পায়চারি করে সুযোগ বুঝে টিকিটের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁরা টিকিট পেয়েও যান। পেছনের লোকজন যতই চেঁচামেচি বা কটুবাক্য বর্ষণ করুক, তাতে তাঁদের কিছু যায়–আসে না।
বিভিন্ন ভবনের লিফটের সামনেও দেখা যায় লোকজন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর কোট-টাই পরিহিত কিছু লোক লাইনে না দাঁড়িয়ে লিফটে উঠে যান। অনেক অনুষ্ঠানে দেখা যায় বুফে পরিবেশিত খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে আমরা লাইনে না দাঁড়িয়ে হুড়োহুড়ি করি। মাত্রাতিরিক্ত খাবার নিয়ে নষ্ট করি। সে কারণে কেউ কেউ হয়তো খাবার পান না। আমরা চায়ের দোকানে বসে পায়ের কাছে থুতু ফেলি, বেসিনের ট্যাপের পানি মুখে ছুড়তে গিয়ে অন্যের গায়ে ফেলি—এসব বলে শেষ করা যাবে না।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের লোন রিকভারি টিমের কয়েকজন কর্মচারী আরেকটি বেসরকারি অফিসে হাজির হয়ে একজনকে পাকড়াও করলেন ছোট্ট লোনের তিনটি কিস্তি পরিশোধ না করার দায়ে। ব্যাংকের উত্তেজিত লোকজনের একজন পুলিশ ডেকে তাঁদের ঋণগ্রহীতাকে ধরে নেওয়ার কথাও বললেন। আর উল্টো চিত্র হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি কোনো ব্যাংকে ঢোকার পর ব্যাংকের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাঁর সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
জয়পুরহাটের আজিজার রহমানের কথা অনেকের হয়তো মনে আছে। জনতা ব্যাংক থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি আলু চাষ করেছিলেন। ফলন ভালো হলেও আলুর দাম না পাওয়ায় তিনি ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি বলে ব্যাংকের করা মামলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে তাঁকে থানায় নেওয়া হয়েছিল। আর সেই জনতা ব্যাংকই বড় ঋণখেলাপির ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি সুদ মওকুফ করেছিল। ব্যাংকপাড়ায় বাটপারির শিকার নিরপরাধ জাহালমের যৌবন খুইয়ে ফেলার উপাখ্যান তো সবার জানা।
এবার দেখা যাক চিন্তাভাবনায় আমরা কতটা অগ্রগামী। এক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার প্রথম সন্তানটি মেয়ে হওয়ার খবরটি তিনি তাঁর বন্ধুদের জানাননি। তবে দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হওয়ার পর খবরটি তিনি খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই বন্ধুদের জানালেন। গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এক নারী এ শহরের এক হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। স্বামীকে পুত্রসন্তান উপহার দিতে শরীর সাপোর্ট না করলেও সেই নারীকে ষষ্ঠবার গর্ভধারণ করতে হয়েছে। এ রকম অসংখ্য পুরুষ এ সমাজের বিভিন্ন স্তরে আছেন।
আমরা বাক্স্বাধীনতার কথা বললেও অন্যের কথা নিজের মতাদর্শের সঙ্গে না মিললে বিরুদ্ধাচরণ করি। কখনো নাজেহালও করি। যে লোক বিদেশে গিয়ে পাসপোর্ট ছিঁড়ে থেকে গিয়েছেন, তিনিও মতাদর্শের সঙ্গে না মেলায় আরেকজনের সমালোচনা করেন, যিনি বিদেশের উন্নত জীবন ছেড়ে ফিরেছিলেন মানুষের জন্য কিছু করতে। আর আমরা অন্যদের যে বিষয়ে জ্ঞান দিই, সেটা নিজেরাই–বা কতটা মেনে চলি।
ধরা যাক, পলিথিনের অপকারিতার ওপর এক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে বা সেমিনারে লেকচার দিলেন। লেকচার শেষে তিনিও হয়তো পলিথিনে দেওয়া বাজারসদাই নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। সাম্য ও ন্যায়বিচার নিয়ে মুখে ফেনা তুললেও আমাদের অনেকের অন্তরে ‘তালগাছটি আমার’। ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। কিন্তু ব্যক্তির বিবেক, সুযোগসন্ধানী মানসিকতা, সুবিধাবাদ, দ্বিচারিতা, অন্যের ক্ষতির চিন্তা ও আমিত্ববাদের সংস্কার ছাড়া কার্যকর রাষ্ট্রীয় সংস্কার কতটা সম্ভব?
মুহম্মদ মোফাজ্জল লেখক ও সাংবাদিক। ই–মেইল: mufazzal.fe@gmail.com