দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) সেবার মানের দিক থেকে সেরা। স্বাস্থ্যসেবার মান, সেবা গ্রহণকারীদের সন্তুষ্টিসহ নানা দিক বিবেচনা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই শ্রেষ্ঠত্বের কথা ঘোষণা করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রাক্কালে এ ধরনের খবর চট্টগ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করেছে, আনন্দিত করেছে। সরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে যাঁরা হতাশ কিংবা যাঁদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে, তাঁরা এবার এই হাসপাতাল নিয়ে আশাবাদী হবেন।
৬৬ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবার জন্য চট্টগ্রামের কোটি মানুষের প্রধান ভরসা এই প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ২ হাজার ২০০ হলেও ৬০টি বিভাগ মিলে প্রায় সময় ৩ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকে। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে সেবা নিচ্ছেন প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন হাজার রোগী। ছোট–বড় মিলিয়ে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক অস্ত্রোপচার হয় এই হাসপাতালে। এত মানুষের চিকিৎসাকে ঘিরে চিকিৎসক, ইন্টার্নি, শিক্ষার্থী, নার্স, কর্মকর্তা, তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির নানা কর্মী, রোগীর আত্মীয়স্বজন মিলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সব সময় হাজার মানুষের কোলাহলময়, শোরগোলপূর্ণ একটি স্থান হিসেবেই পরিচিত।
শয্যাসংখ্যার অতিরিক্ত রোগীর কারণে মেঝেতে, বারান্দায়, করিডরে আসন পাতা থাকে। সেখানে রোগী এবং তাদের অভিভাবক সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুবিশাল অবকাঠামোটিতে যে প্রতিবেশ তৈরি হয়ে আছে, তাতে সব রোগীর প্রতি সমানভাবে দৃষ্টি রাখা সংশ্লিষ্টদের কঠিন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি হাসপাতালের বিশাল অবকাঠামোটি পরিচ্ছন্ন রাখা এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখাও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। কিন্তু সেবাগ্রহীতা হিসেবে আমরা এ কথা নিশ্চিত বলতে পারি যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এর আঙিনা এবং ভেতরে, বাইরে পরিচ্ছন্ন রাখার যুদ্ধটি নিয়মিত করেই যাচ্ছে। হাসপাতালটি বর্তমানে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন।
কিছু কিছু চিকিৎসা যা বেসরকারি হাসপাতালে খুবই ব্যয়বহুল, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরে থাকে, সেসব চিকিৎসা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পাওয়া যায়। অ্যানজিওগ্রাম, সিটি স্ক্যান, ক্যানসার রোগীদের রেডিওথেরাপি, ডায়ালাইসিসসহ অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এই সপ্তাহে এই খবরটি প্রকাশের পর এই হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুপ্রেরণা জোগাবে এবং সেবাগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষকে আশাবাদী করে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
এই হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম যা আছে এবং সেসবের ব্যবহার কীভাবে করা হচ্ছে, প্রতিদিন কত রোগী ভর্তি হচ্ছেন, শয্যা কতটা শূন্য, কতটা পূর্ণ হচ্ছে, অতিরিক্ত কত রোগী সেবা পাচ্ছেন, স্বাভাবিক ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম নেওয়ার হার, বড় ও ছোট পরিসরের অস্ত্রোপচারের সংখ্যা, রক্ত পরিসঞ্চালন কতটা নিরাপদ, রোগীদের সন্তুষ্টির হার কেমন—সব মিলিয়ে দেশের ১৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে র্যাঙ্কিং করে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ মূল্যায়নটি হয় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। এই মূল্যায়নে এই প্রতিষ্ঠানটি এবার দেশসেরা হয়েছে।
মূল্যায়নে দেখা যায়, চমেক হাসপাতালে শয্যার বিপরীতে রোগীর হার ছিল ২১৮ শতাংশ। বহির্বিভাগে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা ১ লাখ ৪২ হাজার ৫৫২। মাসে ৫ হাজার ৬৫৮টি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাইনর সার্জারি হয়েছে ৬ হাজার ২০টি। ২ হাজার ৩৭৩টি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মেজর সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে ২ হাজার ৮৭১টি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার বেশি সেবা প্রদানে পূর্ণাঙ্গ স্কোর পেয়েছে চমেক হাসপাতাল। চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান মনে করেন, এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
চট্টগ্রাম শহরে চমেক হাসপাতাল ছাড়াও ২৫০ শয্যার আরেকটি সরকারি হাসপাতাল আছে। জেনারেল হাসপাতাল নামে ব্রিটিশ আমলের এই হাসপাতালটি করোনাকালে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও সাধারণ সময়ে তেমন রোগী থাকে না। সিটি করপোরেশন পরিচালিত হাসপাতালও আছে। ছোট–বড় মিলিয়ে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালও রয়েছে। তারপরও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ চমেক হাসপাতালকে নিতে হচ্ছে। যেকোনো বড় দুর্ঘটনা, জটিল রোগ, বড় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই হাসপাতালে। তাই এই হাসপাতালটির কাঁধের বোঝা দিন দিন ভারীই হচ্ছে। সেই তুলনায় এই হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধা, পরিকাঠামো এবং সরকারি বরাদ্দ বাড়ছে না। রোগী বাড়ছে, কিন্তু জনবল ও সরঞ্জাম বাড়ছে না। সেবায় সব কটির সেরা, কিন্তু বরাদ্দ পায় অন্য হাসপাতালগুলোর তুলনায় কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ২০০ শয্যার চমেক হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭৪ কোটি ৭৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। পাশাপাশি ২ হাজার ৬০০ শয্যার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ ছিল, ১৬৭ কোটি ৮১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে শয্যা চমেক থেকে ৪০০ বেশি। তার জন্য দ্বিগুণের বেশি বরাদ্দ পেল। কম শয্যার কয়েকটি হাসপাতালও চমেক থেকে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে। যেমন এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বরাদ্দ পেয়েছে ১০৮ কোটি টাকার ওপরে। ১ হাজার ২০০ শয্যার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বরাদ্দ পেল ৮৯ কোটি ৪১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ৯০০ শয্যার সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও ৭৬ কোটি টাকার ওপরে।
শয্যাসংখ্যা অনুযায়ী, রোগীর সংখ্যা বিবেচনা করে সেই অনুপাতে বরাদ্দ প্রদানের কথা, কিন্তু সেটি অনুসরণ করা হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী চমেক হাসপাতাল বরাদ্দ যা পেয়েছে, তার দ্বিগুণ হওয়ার কথা। এই বৈষম্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের হতাশ করেছে। চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিকে এই নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তাঁরা। চমেক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাতেও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণে হাসপাতাল প্রশাসনের নাভিশ্বাস হচ্ছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবা মাঝে মাঝে বন্ধ থাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ৩০ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু শেষমেশ সব মিলিয়ে চার কোটি টাকা পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।
চমেক হাসপাতাল সীমিত সাধ্যে যা করেছে, তা সারা দেশের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। কিন্তু সীমাবদ্ধতা তাদের সংকুচিত করে রাখবে। রোগী সেবা ও হাসপাতালের মান বাড়াতে জনবল, সরঞ্জাম বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। নয়তো সেরা খেতাবটি ধরে রাখা যাবে না।
প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৫০ সাল থেকে এই দিনটি পালিত হচ্ছে। এই দিনটি পালনের মূল লক্ষ্যটা হলো সবার জন্য মানসম্পন্ন চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য অন্তত প্রথমেই বৈষম্য দূর করে সব হাসপাতালের জন্য সমান বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। সেবাব্রতে যে অর্জন লাভ করল চমেক হাসপাতাল সেটি যেন বঞ্চনায় ম্লান হয়ে না যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের চট্টগ্রামবাসীর দাবি এটাই।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক