২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়ে আততায়ীর হাতে নিহত হন মাহমুদা আক্তার মিতু। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী তিনি। হতভাগ্য মিতু নিজের সন্তানকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিতে বাসা থেকে রাস্তার মোড়ে এসেছিলেন। সেখানে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই হত্যার ঘটনায় মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার যে মামলা করেছিলেন, তাতে তাঁকেই প্রধান আসামি করে গতকাল আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার প্রধান আসামি বাবুল আক্তার জেলহাজতে।
এর মধ্যে আদালতে এক আবেদনে বাবুল আক্তার অভিযোগ করেছেন, পুলিশি হেফাজতে থাকাকালে তাঁর কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জোর করে আদায় করার জন্য সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তাঁকে নির্যাতন করেছেন। এ আবেদন সংশ্লিষ্ট আদালত নিষ্পত্তি করবেন। তাই বিষয়টি অনালোচিত রইল।
আলোচনায় থাকবে শুরু থেকে পুলিশ ঘটনাটিকে নিয়ে কী ধরনের বিভ্রান্তিকর কার্যক্রম চালাচ্ছে, এসব নিয়ে। ঘটনার দিন বাবুল আক্তার সরকারি কাজে ঢাকায় ছিলেন। খবর পাওয়ার পরপরই চট্টগ্রামে যান। তিনি অন্য বিষয়াদি সম্পন্ন করার পাশাপাশি পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন।
দাবি করেন, জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ একটি মহল ঘটনাটিতে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে। তবে এজাহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ ছিল না। এরপর তিনি দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন তাঁর নতুন কর্মস্থল পুলিশ সদর দপ্তরে। অবস্থান করতে থাকেন তাঁর শ্বশুরালয়ে।
ঘটনাটি সারা দেশে সাড়া ফেলে। দায়িত্বরত একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী সন্তানকে স্কুলে দিতে যাওয়ার সময় নিহত হওয়া আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থার দুর্বলতা বলেই অনেকে মনে করেন। মামলাটি তদন্তাধীন ছিল ডিবির কাছে। ঘাতক শিগগিরই আইনের আওতায় আসবে—এমনটি আশা করছেন অনেকে।
এর মধ্যে সে বছরের ২৪ জুন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা বাবুল আক্তারকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদ করেন অন্তত ১৫ ঘণ্টা। সে জিজ্ঞাসাবাদকালে চট্টগ্রামে বাবুল আক্তারের চাকরিগত সোর্স মুসা উপস্থিত ছিলেন বলেও কোনো কোনো পত্রিকা থেকে জানা যায়।
হামেশাই আমাদের দেশে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। বছরের পর বছর পড়ে থাকে হত্যা মামলার তদন্ত, আর সাক্ষী অনুপস্থিতির জন্য বিচার। এ ঘটনাও সাড়ে ছয় বছর আগের। মাহমুদা আক্তার মিতুর রাজপথে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়া নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই।
তাঁকে পুলিশ ২২ জুন গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায় বলে মুসার স্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। সে রাতের জিজ্ঞাসাবাদের পর বাবুল আক্তারের কাছ থেকে চাকরির ইস্তফাপত্রে সই নেওয়া হয় বলে পত্রপত্রিকায় খবর এসেছিল। এর প্রায় সপ্তাহ দুই পর খবর হয় ইস্তফাপত্রটি যথাযথ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে।
এর পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি অনেকটা ঢিমেতালে চলছিল। সে সময় মুসা ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যান। মামলার সম্ভাব্য আসামি হতে পারেন—মুসার এরূপ দুজন সহযোগী রাশেদ ও নুরুন্নবী সে সময় রাঙ্গুনিয়ায় নিহত হন ‘বন্দুকযুদ্ধে’। ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছিল। তবে সব ক্ষেত্রেই অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া যায় না।
এরপর মামলাটির তদন্তের ভার নেয় পিবিআই। গতকাল পিবিআই যে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাতে মোট সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। আদালতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। এখানে বড় ভূমিকা থাকে বাদীপক্ষের।
তাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ ইত্যাদি দিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা করতে হবে। আসামিপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেবে। এ ক্ষেত্রে বাদীপক্ষের সাক্ষ্যপ্রমাণের দুর্বলতা, অসংগতি ইত্যাদি থাকলে তার সুফল পেতে পারে আসামিপক্ষ।
নিহত ব্যক্তির প্রতি আমাদের যত সমবেদনাই থাকুক, মামলায় আসামিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে না পারলে শাস্তি বিধান আদালতের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া খাপছাড়া কিছু অবস্থা ও অসংগতির পুরো ব্যাখ্যা অভিযোগপত্রে থাকা দরকার। যেমন বাবুল আক্তারকে ঢাকা ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করার বিষয়টি সে সময় পত্রপত্রিকায় এসেছিল। তাঁর কাছ থেকে ইস্তফাপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার কথাও আমরা গণমাধ্যমে জেনেছি। কদিন পর গৃহীত হয় সে ইস্তফাপত্র।
বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজব্যবস্থায় বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তার এমন একটি পদ অবশ্যই আকর্ষণীয়। সেখানে বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়েছেন, এমনটা লেখা থাকলেও আমাদের পক্ষে তা বিশ্বাস করা কঠিন। উল্লেখ্য, তাঁর বাবা ও শ্বশুর উভয়েই চাকরি শেষ করেছিলেন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে।
এরপর থাকছে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের আরেক খলনায়ক মুসার পরিণতি নিয়ে। মুসাকে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল, এ ব্যাপারে কিছু তথ্য রয়েছে। আর সম্ভবত তাঁর জবানি অনুসারেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ধরে নেন, বাবুল আক্তার নিজেই ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাঁরা তাঁকে পুলিশ থেকে বিদায় করার সিদ্ধান্ত হয়তোবা নিয়েছেন এ কারণেই।
তা না হলে স্ত্রীর সদ্য মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তরুণ এ কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির নিষ্ঠুর শাস্তি আসার কথা নয়; বরং তাঁর একটি সুবিধাজনক পদায়নের আলোচনাই হওয়ার কথা। তবে প্রশ্ন থাকে, যদি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধরে নেন ঘটনাটির নেপথ্যের নায়ক বাবুল আক্তার, তাহলে কি তাঁর চাকরিচ্যুতিই যথেষ্ট? মোটেই নয়।
তখনই তো তাঁকে হত্যা মামলায় সংশ্লিষ্ট করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো, পুলিশের যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদকালে উপস্থিত ছিলেন এবং ইস্তফাপত্র গ্রহণ করেছেন, তাঁরা কি এ মামলায় সাক্ষী?
বাস্তবিক পক্ষে তাঁরা ঘটনা ঘটার অল্প দিন পরেই এ জিজ্ঞাসাবাদে হাজির ছিলেন। বিবেচ্য মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিযোগপত্রে সাক্ষীর তালিকায় নাম নেওয়া হয়েছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নই।
ঘটনার অল্প দিন পরেই বাবুল আক্তারকে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ডেকে নেওয়া, দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ ও পদত্যাগ করানোর মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ মামলার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ার কথা। বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটেছে তখন কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে। আর যদি তাঁদের বিবেচনায় বাবুল আক্তার ঘটনার জন্য দায়ী না-ই হন, তাহলে তাঁকে ইস্তফা দিতে হবে কেন? এখন তো মামলার প্রধান আসামি হিসেবে তিনি অভিযুক্ত হলেন।
হামেশাই আমাদের দেশে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। বছরের পর বছর পড়ে থাকে হত্যা মামলার তদন্ত, আর সাক্ষী অনুপস্থিতির জন্য বিচার। এ ঘটনাও সাড়ে ছয় বছর আগের। মাহমুদা আক্তার মিতুর রাজপথে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়া নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই।
বিবেচ্য বিষয় থাকবে কে বা কারা এ ঘটনা ঘটাল। এ অন্ধকার উন্মোচনের কিছু সুযোগ নষ্ট করা হয়েছে। ঘাতক বলে চলমান তদন্তেই চিহ্নিত মুসা হাওয়া হয়ে গেছেন। তিনি জীবিত থাকলে এবং দেশত্যাগ না করলে পুলিশের পক্ষে ধরে ফেলা কঠিন কিছু নয়। ঢাকার ডিবি দপ্তরে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার যে কাহিনি আছে, সেটা সত্য হলে তাঁর তো ছাড়া পাওয়ার কথা নয়।
আর তাঁর বক্তব্যেই তো সেই রাতে বাবুল আক্তারের জীবন ও এই মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তা-ই যদি না হয়, তাহলে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ এক কর্মকর্তার ওপর এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেওয়া তো অমানবিক হয়েছে।
আর সত্য হলে মুসা আটক হওয়ার কথা ছিল তখনই। বাবুল আক্তারও গ্রেপ্তার হওয়ার কথা ছিল। কথিত বন্দুকযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দুই আসামির মারা যাওয়ার কথা ছিল না। মুসা ও তাঁদের উভয়কে আইনের আওতায় আনলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে মামলাটির তদন্তকাজ অনেক স্বচ্ছভাবে অগ্রসর হতো।
আর তা হতো বেশ আগে। কিন্তু এসবের অনেক কিছু না করে এ ধরনের মামলা পরিচালনার সুফল কোন পক্ষ পাবে, তা ধারণা করতে পারছি না। তবে যতটুকু জানি, সব ধরনের যুক্তিসংগত সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করতে হয় বাদীপক্ষকেই। আমরা চাই প্রকৃত দোষী সাজা পাক।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com