মতামত

ব্যয় সংকোচনে সরকারি কর্মকর্তা ও গণ্যমান্যরা পথ দেখাক

সরকারি কর্মকর্তারা মিলনায়তনের ভেতরে কর্মশালায়। আর বাইরে তাঁদের গাড়ি স্টার্টে রেখে অন্তত ৩০টি সরকারি গাড়ির চালক গাড়ির ভেতরে এসি ছেড়ে শুয়ে-বসে সময় পার করছিলেন। সম্প্রতি রাজশাহী জেলা শহরে এ ঘটনা ঘটে।
ছবি: প্রথম আলো

মিতব্যয়িতা একটি বিরল মানবীয় গুণ। পৃথিবীর প্রায় সব সফল মানুষের মধ্যে পরিমিতিবোধ ও মিতব্যয় একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে দেখা যায়। সংকটকালে বাধ্য হয়েই সবাইকে ব্যয় সংকোচন করতে হয়। এটি ব্যক্তিগত সংকট বা সামষ্টিক জাতীয় সংকট—দুই-ই হতে পারে। গোটা বিশ্ব এখন নানামুখী আর্থিক ও জীবনযাত্রার সংকট মোকাবিলা করছে। আমরা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও দেশীয়—দুই রকম সংকটের মধ্যেই আছি। এত দিন সংকটের বিষয়টিই স্বীকার করা হতো না। দেশে সব সময় ‘উন্নয়নের জোয়ারের’ কথাই বলা হতো। জোয়ারের পর প্রাকৃতিক নিয়মে ভাটার টান লাগে। সে ভাটার টান কত তীব্র ও অসহনীয় হতে পারে, তা সমাজের ওপরতলার মানুষ না বুঝলেও নিচতলার মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সরকারও এখন ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপ নিয়েছে।

সরকার জ্বালানির আমদানি–সংকট, ভারসাম্যহীন ডলারের বিনিময় মূল্যমান, ব্যাংক খাতের সম্পদ হ্রাস, নিত্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, পুঁজির দেশান্তর, প্রবাসী আয়প্রবাহ কমে যাওয়াসহ সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সমস্যা ও সংকট মোকাবিলা করছে। অনেক ক্ষেত্রে দেশি সম্পদ ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার নানা নীতি গ্রহণ করেছে। যেমন জ্বালানি–সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লোডশেডিং চলছে। কম প্রয়োজনে বিদেশভ্রমণ বন্ধ করা হয়েছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। রাত আটটার পর দোকানপাট বন্ধ রাখা হচ্ছে। সব উপদেশ, নির্দেশ ও পরামর্শ সর্বত্র সমানভাবে পালিত হচ্ছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু এ পদক্ষেপগুলো মানুষ প্রত্যাখ্যান করেনি। তবে যথাযথভাবে প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য সরকারি অফিস ও স্থাপনাগুলোতে প্রথমে নজির স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। তখন জনগণের ওপরও নৈতিক চাপ আরও বাড়বে।

মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসামরিক আমলারা গাড়ি-বাড়ির এসি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেছেন, মানুষ সেটি দেখতে চায়। পত্রিকান্তরে জানা গেল, কোনো এক সরকারি অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের পার্ক করা খালি গাড়িতে এসি চলছে, চালকেরা অবসরে আরাম করছেন। সরকার যদি সত্যিকার অর্থে ব্যয় সংকোচন ও জ্বালানি সাশ্রয়ে আগ্রহী হয়, তাহলে প্রতিটি সরকারি দপ্তরের গাড়ির জ্বালানি ও প্রতি মাসের বিদ্যুৎ বিলের হিসাব মনিটর করুক। এ ব্যাপারে সরকারি দপ্তরগুলোর একটি ‘রাজনীতি’ আছে। তারা ধরে নেবে, ব্যয় সংকোচনের কারণে যদি তিন মাস জ্বালানির ব্যবহার ২৫-৩০ শতাংশ কমে যায়, পরবর্তী বছরের বাজেটে ওই পরিমাণ অর্থ কমে যেতে পারে। তাই হয়তো অনেক ক্ষেত্রে আমলারা দ্বিধান্বিত।

এসব সত্ত্বেও সরকারের দিক থেকে জ্বালানি সাশ্রয়ের একটি বড় ব্যয় সংকোচনী কার্যক্রম নিতেই হবে। গত ১০ বছরে সব সরকারি কার্যালয় ও দপ্তরের ভবন, পরিসর, অফিসের সাজসজ্জার অনেক উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে যানবাহন ও এসির ব্যবহার। বেতন বৃদ্ধির কথা নাই–বা বলা হলো। কিন্তু নাগরিক সেবার মান কতটুকু বেড়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জনপ্রশাসনের রাজস্ব ব্যয়। এখানে রাশ টানার প্রয়োজন আছে। মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, করপোরেশন—সর্বত্র যানবাহন ও জনবলের হিসাব করে বাস-মাইক্রোবাসে চলাচল বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সরকারি গাড়ির ব্যক্তিগত ব্যবহার সীমিত করার কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে। মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী ও সচিব ছাড়া বাকি সবাই কেন বাস বা মাইক্রোবাসে অফিসে আসা–যাওয়া করতে পারবেন না! এ ক্ষেত্রে ধন্যবাদ দিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, তাঁরা বিনা দ্বিধায় বাসে যাতায়াত করেন।

যানবাহনের জ্বালানির ব্যবহার, সার্বিক ব্যয় সংকোচন ও সভ্য-অনাড়ম্বর জীবনযাপনের একটি সামাজিক আন্দোলন সূচিত হোক। আমাদের মন্ত্রী, এমপি, উচ্চপদস্থ সামরিক–বেসামরিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এ আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। সবকিছু সরকারি নির্দেশে হতে হবে, এমন নয়।

সংকট অনেক ক্ষেত্রে নতুন পথ দেখায়। এ সংকটও আমাদের একটি ব্যয় সাশ্রয়ী প্রশাসনিক নিয়মনীতি গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। এরশাদ আমলে অফিসে স্যুট-টাই পরার নিয়ম করা হয়। চৈত্রের দুপুরে স্যুট পরলে অসহ্য গরমে কাজ করা মুশকিল। তাই লাগল এসি, অফিসকক্ষ হলো এয়ারটাইট। অফিসকক্ষগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী করুন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি—দুই মাস ছাড়া বাকি সময় এ দেশে স্যুট পরার বিধান রহিত করুন। আবহাওয়া ও দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শোভন পোশাক পরার স্বাধীনতা সবার থাকুক। যেসব চাকরিতে ‘ইউনিফর্ম’ পরার বাধ্যবাধকতা নেই, সেখানে কর্মকর্তাদের পছন্দ অনুযায়ী শোভন পোশাক পরার অধিকার আছে।

যানবাহনের জ্বালানির ব্যবহার, সার্বিক ব্যয় সংকোচন ও সভ্য-অনাড়ম্বর জীবনযাপনের একটি সামাজিক আন্দোলন সূচিত হোক। আমাদের মন্ত্রী, এমপি, উচ্চপদস্থ সামরিক–বেসামরিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এ আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। সবকিছু সরকারি নির্দেশে হতে হবে, এমন নয়। আমাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সপ্তাহে এক দিন, দুই দিন বা সর্বোচ্চ তিন দিন হেঁটে, সাইকেলে বা রিকশায় নিজ নিজ দপ্তরে যেতে পারেন কি না, দেখুন। সব মেয়র, জেলা পরিষদের প্রশাসক সেটি শুরু করতে পারেন। দেখা যাবে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা জজ, ডিসি, এসপি, অন্য সরকারি কর্মকর্তারা স্বেচ্ছায় তা করছেন। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সাইকেল চালানোর সুযোগ অবারিত। পদস্থ কর্মকর্তারা এ কাজ করলে দেশবাসী খুবই আনন্দিত হবে।

জনগণের জন্য গণপরিবহনের বিকল্প কিছু হতে পারে না। তবে ফুটপাত দখলমুক্ত হলে মানুষ স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে যেতে অনায়াসে হাঁটবে। সে জন্য সিটি মেয়ররা ফুটপাতগুলো হাঁটার উপযোগী করে দিন। প্রতিটি অফিসে ‘হাঁটাহাঁটি’ গ্রুপ গঠিত হোক, যাঁরা একে অপরকে ডেকে একসঙ্গে পদব্রজে অফিস যাওয়া–আসা করবেন। দুজনের রিকশা গ্রুপ হতে পারে। হতে পারে সাইক্লিস্ট গ্রুপ। অফিসফিরতি সময়ে চার–পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটা যেতে পারে। বিশেষ করে শহরের স্কুলগুলোতে ফুটপাত ধরে দলবদ্ধভাবে হেঁটে বাসায় যাওয়া–আসা করার অভ্যাসকে উৎসাহিত করার জন্য স্কুল থেকে গ্রুপ করে অভিভাবকদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। তাহলে শহরগুলোতে প্রাইভেট কার চলাচলও কমে আসবে। দেশের বায়ুদূষণ কমবে, জ্বালানি সাশ্রয় হবে, বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে, সরকারি ব্যয় হ্রাস পাবে। মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন হবে। বৃদ্ধি পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া জাতি হিসেবে আমাদের সুনাম।

ড. তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ ও শাসনবিশেষজ্ঞ

ই–মেইল: tofail101@gmail.com