সাতটি ধাপে ভারতের অষ্টাদশ ‘লোকসভা নির্বাচন ২০২৪’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৭টি রাজ্য ও ৪টি ইউনিয়ন টেরিটোরিতে মোট ১০২টি আসনের প্রথম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২০১৯–এর নির্বাচনে এই ১০২ আসনের ৯৭টির ফলাফল ছিল নিম্নরূপ: এনডিএ বা মোদি জোট ৪৩, বর্তমান ‘ইন্ডিয়া’জোট ৪৮ এবং অন্যান্য ০৬। প্রথম ধাপের ১০২ আসনের এবারে মোট প্রার্থী ছিল ১ হাজার ৬২৫। তার মধ্যে ১৩৫ জন নারী (৮%) এবং ২৫০ (১৬%) জনের বিরুদ্ধে নানা ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে।
এবারের (২০২৪) নির্বাচন টানা গত দুবারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য তৃতীয়বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হ্যাটট্রিক ও ইন্ডিয়া জোটের জন্য মোদিকে থামানোর চ্যালেঞ্জ। ভারতের লোকসভার মোট আসন (৫৪৩+২) ৫৪৫, ৫৪৩টি আসন সাধারণ ভোটে নির্বাচিত এবং ২টি আসন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত সংসদ সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত।
সাতটি ধাপে সব আসনের নির্বাচন শেষ হওয়ার পর একসঙ্গে সব আসনের প্রাপ্ত ব্যালট গণনা করা হবে। ছয়টি বিরতিতে ৭টি ধাপের সব নির্বাচন শেষে ফলাফল পাওয়া যাবে আগামী ৪ জুন। ভারতের মোট জনসংখ্যার একটি অনুমিত সংখ্যা ১৪৪ কোটি ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৮৫২, ভোটার সংখ্যা প্রায় ৯৭ কোটি। ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রথম দফার ভোটে গড়পড়তা ৬৩% ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল।
২০১৯–এ অনুষ্ঠিত ১৭তম লোকসভার একটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নির্বাচিত লোকসভা সদস্যদের মধ্যে নারী সদস্য ছিলেন ৭৮ জন (১৪%), যা সব সময়ের সর্বোচ্চ সংখ্যা। ১৬তম লোকসভায় তা ছিল ৬২ জন। একই লোকসভার ২৬৭ জন ছিলেন প্রথমবারের নির্বাচিত এমপি এবং ২৩৩ (৪৩%) জনের ফৌজদারি অপরাধের সংশ্লিষ্টতার রেকর্ড ছিল। মোট সদস্যের ৩৯% ছিলেন পেশাদার রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী। বাকিরা অন্য নানা পেশার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
১৭তম লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির একক প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৭.৩৬% এবং আসন ২৯৩ পরে তা ৩০৩–এ উন্নীত হয়। বিজেপির নেতৃত্বে গঠিত এনডিএ জোটের সমন্বিত মোট ভোট ছিল ৪৫% এবং মোট আসন ৩৫৩। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নিজস্ব আসন ছিল ৫০ এবং কংগ্রেস ও জোট সঙ্গীদের সমন্বিত আসন হয়েছিল মোট ৯১। দুই জোটের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আসন দাঁড়ায় ৯৮। ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে মোট ৩৮টি দল ও অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করে।
লোকসভার মূল কাজ ‘আইন প্রণয়ন’। এ প্রক্রিয়ার ওপর এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৭তম লোকসভায় মাত্র ১৬% বিল কমিটি পর্যায়ে আলোচনার জন্য প্রেরিত ও আলোচনা হয়। বাকি বিলগুলোর ৫০% দুই ঘণ্টার কম সময় ফ্লোরে আলোচনা করে পাস হয়ে যায়। ১৭তম লোকসভা বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়ে মাত্র ৫৫ দিন অধিবেশন মিলিত হয়। ২০১৯–এ গঠিত ১৭তম লোকসভার এ সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ ভারতকে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ বলা হলেও বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রচর্চার একটি অবক্ষয়ের ইঙ্গিত বহন করে বলে ধারণা করা হয়।
ভারতে নির্বাচনী ফলাফলের ওপর বহু জরিপ নানা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম করে থাকে। ২০২৪ সালের মার্চ ও এপ্রিল এ দুই মাসের মধ্যে সম্পাদিত ৫টি সংস্থার ৮টি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে সব জরিপেই মোদির নেতৃত্বের এনডিএ জোট বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে আছে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মোট প্রাপ্ত ভোট ও আসন দুই দিক দিয়েই পেছনে রয়েছে। এনডিএ জোটের ভোট প্রাপ্তির ইঙ্গিত সর্বোচ্চ ৫২% এবং সর্বনিম্ন ৪২.৬%।
সেখানে কংগ্রেস নেতৃত্বের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ভোটপ্রাপ্তির হার সর্বাধিক ৪২ ও সর্বনিম্ন ৩৯ দশমিক ৮%। আসনের হিসাবে এনডিএ জোটের অবস্থান ৪১১ থেকে ৩৭৩–এর মধ্যে এবং ইন্ডিয়া জোট ১৫৫ থেকে ১০৫ মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই দুই জোটের বাইরের দলগুলোর ভোট ২০-৬% এবং আসনসংখ্যা ৪১ থেকে ২১–এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলশাসিত পশ্চিমবঙ্গের ওপর পৃথক চারটি জরিপের তিনটিতে এনডিএ বা বিজেপি এগিয়ে আছে, শুধু ‘ইন্ডিয়া টুডে’র একটি জরিপে তৃণমূলকে আগানো দেখা হয়েছে। নিউজ নাইন ও নিউজ১৮–এর জরিপে পশ্চিম বাংলার ৪২টি আসনে বিজেপি যথাক্রমে ২৬ ও ২৫ এবং তৃণমূল ১৬ এবং ১৭–তে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এসব জরিপে কংগ্রেসকে কোনো আসনে দেখা যায়নি।
ইন্ডিয়া টুডের জরিপটিতে পশ্চিমবঙ্গের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া অন্যান্য দল যথা সিপিএম ও কংগ্রেস নিয়েও বিশ্লেষণ রয়েছে। ইন্ডিয়া টুডে আসনের দিক থেকে তৃণমূল ২২ ও বিজেপি ১৭ এবং কংগ্রেসকে একটি আসনে বিজয়ী দেখিয়েছে। সিপিআই(এম)–কে কোনো আসনে বিজয়ী পাওয়া যায়নি। তবে ভোটপ্রাপ্তির হারে তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে।
তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের ভোট যথাক্রমে ০.২ ও ০.৬ কমেছে। কংগ্রেস ও সিপিআই (এম) উভয়ের ভোটের হার বেড়েছে। ২০১৯–এর তুলনায় ভোটের হার কংগ্রেস ৬% থেকে ৯% এবং সিপিআই ৪/৫ থেকে ৭% উন্নীত করতে পেরেছে বলে জরিপে দেখা যাচ্ছে। তবে এ জরিপ পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি হবে। তৃণমূলের আসন ৩৫ পর্যন্ত উঠে যেতে পারে এবং বিজেপি ৯ আসনে নেমে আসতে পারে বলেও বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় ১০ বছর আগের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠন ও শক্তি অনেক সংহত।
পক্ষান্তরে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এ দুটি ইস্যুতে সাধারণ মানুষ তৃণমূলের ওপর বিরক্ত। তবে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মোদি যেমন একটি ব্র্যান্ড, তেমনি পশ্চিমবঙ্গে এখনো মমতামোহ বিশেষভাবে মোহনীয়। এখানে ৩৩% মুসলিম ভোটার এবং ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’–এর উপকারভোগী প্রান্তিক নারী সমাজের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকার কথা। সে দুর্গ অক্ষত থাকলে তৃণমূলের মূল উৎপাটন কঠিন।
ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয় ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এবং ২০১৯ পর্যন্ত ১৭টি জাতীয় এবং ৩৭৬টি রাজ্যসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া প্রতি পাঁচ বছর পরপর ২ লাখ ৮০ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েত, ৬ হাজার ৬৭২টি মধ্যবর্তী স্তরের ব্লক বা মণ্ডল পঞ্চায়েত, ৫০০ জেলা পরিষদ ও হাজার হাজার পৌরসভা/ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিন স্তরের গ্রামীণ ও এক স্তরের নগরসভার নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ, যার মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার নারী।
২০১৯ সালে সাংবাদিক ড. প্রণয় রায় এবং ড. দোরাব সুপারিওয়ালা “দা ভারডিক্ট: ডিকোডিং ইন্ডিয়া’স ইলেকশনস” শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। এ বইয়ে ভারতের ১৭টি জাতীয় ও ৩৭৬টি রাজ্য স্তরের নির্বাচনী ইতিহাসের একটি বিশ্লেষণ করা হয়। ১৯৫২ থেকে ২০১৯ এই ৬৭ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসকে তিনটি নির্বাচনী সময়কালে বিভক্ত করা হয়। তিনটি সময়কাল পৃথকভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
প্রথম সময়কাল ১৯৫২ থেকে ১৯৭৭–এর ২৫ বছর- ‘ক্ষমতাসীনদের কাল’ (প্রো-ইনকামবেন্সি কালপর্ব), দ্বিতীয় ‘বিরোধী’দের সময়কাল ১৯৭৭-২০০২ (ইন্টি-ইনকামবেন্সি কালপর্ব) এবং শেষ সময়কাল ধরা হয়েছে ২০০২-২০১৯ , তা হয়তো বর্তমানে ২০২৪ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এ তৃতীয় কালপর্বকে বলা হয়েছে ‘সমভাগী’কাল ( দ্য ফিফটি-ফিফটি কালপর্ব) ।
প্রথম কালপর্ব ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী দল (কংগ্রেস) ও স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের শাসনকাল। এ সময়কাল নেহরু ও শাস্ত্রী হয়ে ইন্দিরাতে সমাপ্ত হয়। দ্বিতীয় কালপর্ব একধরনের ‘রাগান্বিত’ ভোটারের উত্থানকাল। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ-বিক্ষোভ ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলে। তৃতীয় কালপর্ব হয় ‘স্থিতিশীলতা’র এবং বিশেষত রেকর্ডভিত্তিক ভোটাচরণের কাল। এ কালপর্বে কাজের রেকর্ড দেখে মানুষ ভোট দিয়েছেন।
এ সময়ে ক্ষমতাসীন থেকে নির্বাচন করে জয়-পরাজয় দুটিই হয়েছে। তা ছাড়া ভোট ব্যবস্থাপনা ও ভোটাচরণে লক্ষযোগ্য গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বেড়েছে। ভোটে উত্তরাধিকার ও পরিবারের প্রভাব ইত্যাদির চেয়ে জীবন-জীবিকাভিত্তিক ইস্যু প্রাধান্য পাচ্ছে। সন্ত্রাস ও বুথ দখল হ্রাস পেয়েছে।
১৯৮২-১৯৮৩ সালের পর থেকে ইভিএমের ব্যবহার নির্বাচনী ব্যয়, ব্যবস্থাপনা ও আস্থা-বিশ্বাসে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ভোটারদের আচরণ ও নেতৃত্বকেও তুলনামূলকভাবে অনেক পরিপক্ব করেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিকে একটি মর্যাদাশীল অবস্থানে উন্নীত করেছে।
ভারতের ১৮তম এ জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলো, সরকারি কর্মকর্তা, গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিক সমাজের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরতে পারে। যেমন ভোটের পর এক মাসের অধিক সময় ফলাফল সংরক্ষণ করা এবং এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠা, সক্রিয় নারী প্রার্থীদের সরব প্রচারণা ও নিরন্তর লড়ে যাওয়া।
ভারতের নারী নেতৃত্ব জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচনে আমাদের মতো কোনো কোটা দাবি করে না। ইভিএমের সুফল দল-মত সবার মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ ইত্যাদি লক্ষণীয়।
তোফায়েল আহমেদ শিক্ষক, গবেষক ও শাসনবিশেষজ্ঞ।