শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী সমাবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বৃহস্পতিবার দুপুরে
শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী সমাবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বৃহস্পতিবার দুপুরে

লজ্জা লাগছে ঘুমাতে, আমরা জেগে আছি

‘আমাদের মারছে বাবা, গুলি করছে, আমরা কিছু করি নাই বাবা…তবু আমাদের গুলি করছে বাবা!’ ছেলের ফোন পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম ১৮ জুলাই।

শত শত রক্তাক্ত শরীর দেখেছি সেদিন। কারও শরীর ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা, কারও চোখে ব্যান্ডেজ। উদ্‌ভ্রান্তের মতো বন্ধুর লাশ টানতে দেখেছি ছেলেদের।

শহরের অচেনা অলিগলি পথ ঘুরে, মোড়ে মোড়ে দাঁড়ানো হেলমেটধারী পেশাদার খুনিদের চোখ বাঁচিয়ে, ছেলেকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, মাথার ওপরে তখন ঠাঠা শব্দ করে ঘুরছিল হেলিকপ্টার।

সান্ত্বনা দিয়ে এক বন্ধু ফোনে বলেছিল, ‘যাক, আমাদের ছেলে তো বাড়ি ফিরল!’ কান্না চেপে বন্ধুকে বলেছিলাম, আজকে অনেকের ছেলেই বাড়ি ফিরবে না।

পরদিন নেট বন্ধ। ছেলেকে রেখে আসলাম, বন্ধুর বাড়ি, বসুন্ধরায়। বন্ধুর ছেলেদের সঙ্গে কয়েকটা দিন—আর্জেন্ট পোস্ট-ট্রমাটিক থেরাপিটা দরকার ছিল ওর। যেদিন ফিরলাম, সেদিনই খবর পেলাম, বসুন্ধরায় ব্লক-রেইড হচ্ছে।

পরদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল গুলির শব্দ আর কুকুরের চিৎকারে। উত্তরায় বীভৎস ব্লক-রেইড। সে রাতে রাস্তায় একমাত্র প্রতিরোধ করেছিল পাড়ার নিরীহ কুকুরগুলো।

এর পর থেকে ছেলেকে একরকম পাহারা দিয়েই রাখি, আগলে রাখি, সামলে রাখি দিন-রাত। তবু হঠাৎ একেকটা খবরে হাউমাউ করে কান্না করে ওঠে আমার ২১ বছরের বুড়ো দামড়া ছেলে...অন্য সময় হলে হেসে ফেলতাম, এখন আর হাসি পায় না। এখন ওর সঙ্গে বসে আমিও কাঁদি। রাতে তেমন ঘুম আসে না।

একদিন ভোররাতে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, ছেলের ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বলছে। নিভিয়ে দিয়ে এলাম। পরদিনও দেখি একই অবস্থা। খেতে বসে দুপুরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে, রাতে দরজা বন্ধ করিস না কেন? আলো জ্বালায় ঘুমায় যাস কেন?’ অল্প হেসে একটু লজ্জা পেয়ে ছেলে বলল, ‘ভয় লাগে।’

আমাদের ভাষাহীন এক দশক ভয় কালচারের বাম্পার ফলন শুরু হয়েছিল এই শাহবাগ-শাপলার পর থেকেই। কথা বলতে ভয়, গান গাইতে ভয়, ছবি আঁকতে ভয়, ছবি বানাতে ভয়। ভয় জিনিসটার সঙ্গে আমাদের দোস্তি এত পুরোনো হয়ে গেছে যে আমরা একরকম কোনো কিছু না ভেবেই ভয় পাই।

‘ট্রমা’ বা ‘ভয়’ আমাদের পরিবারের সদস্য অনেক দিন। আমরা তিনজন খেতে বসলে, ডাইনিংয়ের খালি চেয়ারটাতে এসে বসে ভয়। কবিতা লিখতে বসলে পেছন থেকে উঁকি দিয়ে আমার লেখা পড়ে ভয়। ‘ভয়’ ভাষাহীন একটা দশকের শিরোনাম, কমন-কালচারের অংশ।

আমাদের ভাষাহীন এক দশক ভয় কালচারের বাম্পার ফলন শুরু হয়েছিল এই শাহবাগ-শাপলার পর থেকেই। কথা বলতে ভয়, গান গাইতে ভয়, ছবি আঁকতে ভয়, ছবি বানাতে ভয়। ভয় জিনিসটার সঙ্গে আমাদের দোস্তি এত পুরোনো হয়ে গেছে যে আমরা একরকম কোনো কিছু না ভেবেই ভয় পাই।

আমাদের নখদন্তহীন মধ্যবিত্ত আড্ডা থেকে ফেসবুক অ্যাক্টিভিজমে, কবি-সাহিত্যিকদের ঝগড়ার আসরে আর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পোস্ট-কলোনিয়াল উৎসব বাসরে—আজকে এই ভয়কেই চ্যালেঞ্জ করছে আমাদের কালেক্টিভ গিল্ট ও গ্রিফ—‘লজ্জা’।

শত শত মানুষের নির্বিচার হত্যার লজ্জা, বুক টান টান করে দাঁড়ানো সাঈদকে দিনদুপুরে গুলির লজ্জা, পানি খাওয়াতে আসা মুগ্ধকে না বাঁচাতে পারার লজ্জা। ভয়ের চেয়ে এই লজ্জা আজকে এত বড় হয়ে গেছে যে আমরা আর ঘুমাতে পারছি না। ছেলেদের আর বলতে পারছি না, তোমরা ঘুমাও, আমরা জেগে আছি। আমাদের লজ্জা লাগছে ঘুমাতে, আমরা জেগে আছি।

  • কামার আহমাদ সাইমন চলচ্চিত্র নির্মাতা