গাইড বই যে কারণে আর সুবিধা করতে পারবে না

একটু দেরিতে হলেও যা ধারণা করা গিয়েছিল, তা–ই ঘটল। বাজারে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ের বিপরীতে গাইড বই এসেছে। যেসব প্রকাশনী এগুলো ছাপিয়েছে, তারা গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই নতুন পাঠ্যবইয়ের লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিল।

এমনকি প্রতিবছর অন্য যেসব মাধ্যম থেকে তারা বইয়ের চূড়ান্ত কপি পায়, সেসব জায়গাতেও যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু এবার বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কারণে বইয়ের প্রেস কপি আগেভাগে তাদের হাতে পৌঁছায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গাইড বই তৈরি করতে তাদের দেরি হয়েছে। তা ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমও তারা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছিল না। তবু বাস্তবতা এই, গাইড বই তৈরি হয়েছে এবং বাজারে এসেছে।

এখন প্রশ্ন, এসব গাইড বই কি নতুন শিক্ষাক্রমকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে? কিংবা নতুন শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে? এর এককথায় উত্তর হলো: না, পারবে না। নতুন শিক্ষাক্রম যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে গতানুগতিক ধারার গাইড বই আদৌ কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

শিক্ষার্থীর জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করতে হলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে দুঃখজনক ঘটনা, বেশির ভাগ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান করেন না—তাঁদের নজর থাকে প্রাইভেট ব্যাচের দিকে। মজার ব্যাপার হলো, ওই সব ব্যাচেও যে সঠিক উপায়ে পড়ানো হয়, তা নয়। সেখানে দেখা যায়, আগে থেকে তৈরি করা নোট শিক্ষক তুলে দেন শিক্ষার্থীর হাতে। শিক্ষার্থীও সেই উত্তর তোতা পাখির মতো মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে যায়। আর পুরোনো প্রশ্নপদ্ধতির এমনই মাজেজা যে নোট মুখস্থ করেই জিপিএ–৫ পাওয়া সম্ভব!

নতুন শিক্ষাক্রমে এই ‘সেলুকাস’ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষায় বসার এখন আর সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, পরীক্ষা ও ফলাফলের ধারণাতেই আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে।

নতুন প্রক্রিয়া বুঝে উঠতে খানিক সময় লাগতে পারে, কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করা গেলে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। এখন বছরজুড়ে মূল্যায়ন করা হবে—শিক্ষার্থী তার শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করতে পারল। যোগ্যতা অর্জনে কোনো ঘাটতি থাকলে শিক্ষার্থীকে সহায়তার মাধ্যমে তা পূরণ করতে হবে। শিক্ষাবছরের যেকোনো সময়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে যোগ্যতার ন্যূনতম পারদর্শিতাটুকু অর্জন করতে হবে। নতুন পদ্ধতিতে ফলাফলে নম্বর থাকছে না; প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে পরবর্তী শ্রেণির রোল বা ক্রমও নির্ধারিত হবে না। তাই আশা করা যায়, নম্বরের পেছনে ছোটার জন্য শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ব্যাকুলতাও থাকবে না।

আশার কথা, এ বছর নতুন শিক্ষাক্রমের গাইড বই তেমন বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক চললে গাইড বই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তবে এই শিক্ষাক্রম সফল করার জন্য শ্রেণি কার্যক্রমের চার ধাপের প্রক্রিয়া ও পারদর্শিতাভিত্তিক মূল্যায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের ভালো করে ধারণা দিতে হবে। আর শিক্ষক-সহায়িকার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। উপরন্তু শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বা ব্যাচ পড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণির পাঠদান প্রক্রিয়াতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন কোনো বিষয় নিয়ে শিক্ষক প্রথমেই আলোচনা শুরু করবেন না। তাঁর আলোচনার আগে শিক্ষার্থীরা ওই বিষয় নিয়ে নিজেরা চিন্তা করবে এবং কথা বলবে। এই ধাপকে শিক্ষাক্রমে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা’ হিসেবে। পরের ধাপে শিক্ষক তাদের কথা শুনবেন এবং সেই কথার ওপর সবার মত গ্রহণ করবেন। একে বলা হচ্ছে ‘প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ’।

তৃতীয় ধাপে শিক্ষক আরও তথ্য ও জ্ঞান যোগ-বিয়োগ করে আলোচ্য বিষয়টির ধারণা স্পষ্ট করবেন। একে বলা হচ্ছে ‘বিমূর্ত ধারণায়ন’। সবশেষে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একই ধরনের নতুন কাজ দিয়ে যাচাই করে দেখবেন তাদের জ্ঞান বা দক্ষতা কতটুকু অর্জিত হলো। শেষের ধাপটিকে বলা হচ্ছে ‘সক্রিয় পরীক্ষণ’। এসব কাজ করার জন্য শিক্ষক মূলত শ্রেণিকক্ষের ওপর নির্ভর করবেন। এ ক্ষেত্রে বাসা থেকে গাইড বই দেখে শিক্ষার্থী লিখে আনবে, এমন সুযোগ নেই।

ধরা যাক, এরপরও কোনো শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের কোনো অনুশীলনী আগেই গাইড বই থেকে মুখস্থ করে ক্লাসে এল। তাতেও শিক্ষকের শ্রেণি কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যাক। মনে করুন, বইয়ের অনুশীলনীতে একটি নমুনা-পাঠ দেওয়া আছে। তার নিচে লেখা আছে, এখানে যেসব শব্দ সমাস-প্রক্রিয়ায় গঠিত, সেগুলো আলাদা করো। আগে থেকেই উত্তর মুখস্থ করে রাখা কোনো শিক্ষার্থী সেই উত্তর না বুঝেই লিখে ফেলতে পারে।

মনে হচ্ছে, বেশ তো! সমস্যা কোথায়? সমস্যা ধরা পড়বে এর পরে। শ্রেণি কার্যক্রমের দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষক তাদের লেখা বা বলা উত্তরের ভিত্তিতে সবাইকে মতামত দিতে বলবেন। এমনকি নিজের লেখা উত্তরের পক্ষেও যুক্তি দিতে বলবেন। তখন ঠিকই তিনি শিক্ষার্থীর দুর্বলতা টের পেয়ে যাবেন। তৃতীয় ধাপের ‘বিমূর্ত ধারণায়ন’ শেষে শিক্ষক যখন চতুর্থ ধাপের ‘সক্রিয় পরীক্ষণ’-এ যাবেন, তখনো তিনি শিক্ষার্থীদের অবস্থা বুঝতে পারবেন। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে দুর্বলতা লক্ষ করলে শিক্ষক আবার নতুন কাজের মাধ্যমে চার ধাপের পুরো প্রক্রিয়াটির আবর্তন ঘটাবেন।

শ্রেণি-কার্যক্রমের নতুন এ প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীর গাইডনির্ভরতা বন্ধ করে দেবে। সে যখন দেখবে তার মুখস্থ করা বিষয় ক্লাসে কোনো কাজে আসছে না, তখন শ্রেণির কাজেই বেশি মনোযোগী হবে।

তা ছাড়া অভিভাবকেরা যখন দেখতে থাকবেন পরীক্ষা মানে নম্বর নয়, আর প্রতিনিয়ত মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দুর্বলতা যাচাই করে যোগ্যতা অর্জনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা হচ্ছে, তখন তাঁরাও গাইড বইয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।

আশার কথা, এ বছর নতুন শিক্ষাক্রমের গাইড বই তেমন বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক চললে গাইড বই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তবে এই শিক্ষাক্রম সফল করার জন্য শ্রেণি কার্যক্রমের চার ধাপের প্রক্রিয়া ও পারদর্শিতাভিত্তিক মূল্যায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের ভালো করে ধারণা দিতে হবে। আর শিক্ষক-সহায়িকার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। উপরন্তু শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বা ব্যাচ পড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।

  • তারিক মনজুর অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়