নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের স্থলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করতে যাচ্ছে, এটা বেশ পুরোনো খবর। আইনের খসড়া জাতীয় সংসদে পেশ করার পর সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়েছে। সেখানে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, তাতে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনেরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁদের অন্যতম দাবি ছিল ৪২ ও ৪৩ ধারা বাতিল। কিন্তু সংসদীয় কমিটি রাজি হয়নি। তারা ৩২ ধারা বাতিল করতে রাজি হয়েছে। এই ধারায় ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে যুক্ত করা হয়েছিল। এখানে বাতিল করা হলেও ফৌজদারি কার্যবিধিতে থেকেই যাচ্ছে। এ আইনেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মামলায় প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামকে আটক করা হয়েছিল। তিনি এখন জামিনে থাকলেও তাঁর পাসপোর্ট ও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড আদালতের নির্দেশে আটক আছে।
গত শনিবার বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) আয়োজিত সেমিনারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারা (পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ, গ্রেপ্তার) নিয়ে আপত্তি থাকলেও এই আইনের প্রয়োজন আছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এই ধারা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য রাখা হচ্ছে না। আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমকে আশ্বস্ত করলেও সাধারণ নাগরিকেরা আশ্বস্ত হবেন কীভাবে?
এই ধারার পক্ষে তাঁর যুক্তি হলো, পুলিশের কাজ হলো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সেটা বন্ধ করা এবং অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করা ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা। বিচারে সোপর্দ করতে গেলে কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রয়োজন রয়েছে।
অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে পুলিশের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথাটি তাত্ত্বিকভাবে ঠিকই আছে। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে, সেটাও সরকারকে দেখতে হবে। ধরুন, বিরোধী দলের কয়েকজন নেতা-কর্মী একটি নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হলেন। এরপর পুলিশ কর্মকর্তা তাঁদের গ্রেপ্তার করে বললেন, তাঁরা সেখানে বসে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন। এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে নাশকতার অপরিহার্য উপাদান অস্ত্র ও গোলাবারুদ বের করাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য কঠিন কাজ নয়।
আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো কেবল বিরোধী দল নয়, সংবাদমাধ্যমকেও ‘দেশ ও জনগণের’ শত্রু ভাবে এবং সেই শত্রুকে মোকাবিলা করতে নানা রকম নিবর্তনমূলক আইন জারি করে থাকে। আবার বিরোধী দলে থাকতে তার বিরোধিতাও করে। বিএনপি আমলে আইসিটি আইন পাস হলে আওয়ামী লীগ তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা সেই আইসিটি আইনকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তর্ভুক্ত করে।
সম্প্রতি রাজধানীর লালবাগ থেকে ছাত্রদলের ৬ নেতাসহ বিএনপির ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান ৬ নেতার কাছ থেকে তিনটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁরা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে অস্ত্র সংগ্রহ করছিলেন।
এর আগে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল ইসলাম (জিসান) তাঁর আজিমপুরের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন। দুই দিন আগে যাঁরা নিখোঁজ হলেন, তাঁদের কাছেই পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র পেল। তাদের এ দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
আর জামালপুরের ঘটনা তো আরও চমকপ্রদ। সমাবেশ ও ভাঙচুরের ঘটনা না ঘটে থাকলে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা দিল। যেখানে ঘটনা না ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ গায়েবি মামলা দিতে পারে, সেখানে ৪২ ধারার অপব্যবহারের আশঙ্কাই বেশি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারির সময়ও সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। সরকার গায়ে মাখেনি। সে সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ডিএসএর গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলেছিলেন, আদর্শ আইন হিসেবে উন্নত বিশ্ব এটি অনুসরণ করবে। তাঁকে সবিনয় জিজ্ঞেস করতে চাই, এ রকম একটি অনুকরণীয় আইনটি তাঁরা শেষ পর্যন্ত বাতিল করলেন কেন?
অপরাধ হওয়ার আশঙ্কা থেকে পুলিশ হামেশা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাকড়াও করলেও যেখানে প্রকৃতই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার চক্রান্ত চলে, সেখানে তাদের নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে ষড়যন্ত্রকারীরা একের পর এক বৈঠক করেছেন; যার কিছু বিবরণ ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত সেনাসদস্যরা বেসামরিক পোশাকে কুমিল্লার বার্ডে বহুবার গেছেন, প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন প্রধান মাহবুব আলম চাষীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সে সময় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কোনো কর্মকর্তা তাঁদের গতিবিধি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছেন কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, এ রকম তথ্য নেই।
তাই মন্ত্রী মহোদয় ৪২ ধারার পক্ষে যেসব যুক্তি দিয়েছেন, তা মানা যাচ্ছে না। সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, মানুষের মৌলিক অধিকার, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা, বিশেষ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—এ বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেগুলোর চেতনা ও বিষয়বস্তু—দুটিই সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায়ও আছে।
আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো কেবল বিরোধী দল নয়, সংবাদমাধ্যমকেও ‘দেশ ও জনগণের’ শত্রু ভাবে এবং সেই শত্রুকে মোকাবিলা করতে নানা রকম নিবর্তনমূলক আইন জারি করে থাকে। আবার বিরোধী দলে থাকতে তার বিরোধিতাও করে। বিএনপি আমলে আইসিটি আইন পাস হলে আওয়ামী লীগ তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা সেই আইসিটি আইনকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তর্ভুক্ত করে।
আবারও আইনমন্ত্রীর কথায় আসি। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র বা অন্তর্ঘাত করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ করবে কে? যে পুলিশ ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে থানায় নিয়ে নির্মমভাবে মারধর করে, তারা কীভাবে ৪২ ধারা তামিল করবে?
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে শনিবার রাতে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধর করা হয়। গতকাল রোববার দুপুরে এডিসি হারুনকে ডিএমপির রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে দাঙ্গা দমন বা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।
মারধরের শিকার হয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ। এই দুজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এর আগে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও আন্দোলনরত ছাত্রনেতারা এডিসি হারুনের হাতে নিগৃহীত হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবারও সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের দুই নেতা নিগৃহীত না হলে হয়তো তিনি বহাল তবিয়তেই থাকতেন। এই পুলিশ দিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারা বাস্তবায়ন করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতার ভাগ্য বরণ করতে হবে, তা হলফ করে বলা যায়। সে ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি