পশ্চিমারা দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেই ইউক্রেন যুদ্ধে পতন হবে পুতিনের

এক বছর পরও ইউক্রেনকে দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে সরে আসেননি পুতিন। তিনি বিশ্বাস করেন, ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়ার টিকে থাকার শক্তি বেশি এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের পাল্লা ভারী।
ছবি: রয়টার্স

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভ্লাদিমির পুতিন যখন তাঁর সেনাদের ইউক্রেনে হামলার আদেশ দিলেন, তখন তিনি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেন এবং জাতিসংঘ সনদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের অধিকারকেই অস্বীকার করেন পুতিন। বিশাল সেনাবাহিনী নামিয়ে ইউক্রেনকে ইউরোপের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা অব্যাহতভাবে বাড়িয়ে চলেছেন। এক বছর পরও ইউক্রেনকে দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে সরে আসেননি পুতিন। তিনি বিশ্বাস করেন, ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়ার টিকে থাকার শক্তি বেশি এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের পাল্লা ভারী।

ইউক্রেনে পুতিন যদি সফল হন তাহলে কোনো সন্দেহ নেই যে এরপর তার নজর পড়বে মালদোভার দিকে। বাল্টিক দেশগুলোও বাদ যাবে না। এর ফলে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছেই। ইউক্রেনে রুশদের বিজয় আইনের শাসনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দেবে। ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের মৌলিক নীতি তাতে ভেঙে পড়বে। বিশ্বের অন্য খানেও জোর করে অন্য দেশের ভূখণ্ড দখলের বিপজ্জনক নজির তৈরি হবে।

যাহোক, ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দেশগুলো যদি ঠিক কৌশল গ্রহণ করে এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা যদি অনড় থাকেন তাহলে পুতিন ব্যর্থ হতে বাধ্য। মুক্ত বিশ্বের শক্তি অনুধাবন করতে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।

পুতিন ইউক্রেনে তার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে শুরু করেছিলেন যে কয়েক সপ্তাহের মধ্য ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে পারবেন তিনি। এক বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেন যে ঐক্য ও সহনশীলতা দেখিয়ে চলেছে তাতে দেশটি অবিস্মরণীয় শক্তির পরিচয় দিয়েছে। একটি সাম্রাজ্য শাসন করা ছাড়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুতিন একঘরে হয়ে পড়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

সাহসী গণতন্ত্রপন্থীদের শক্ত বিরোধিতার মুখে পড়েছেন পুতিন। সেটা শুধু ইউক্রেনে নয়, বেলারুশ, মালদোভা, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, সেন্ট্রাল এশিয়া এবং এমনকি তার নিজ দেশে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন সংঘাত শুরুর আগের চেয়ে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ। ইরান, উত্তর কোরিয়ার মতো রাশিয়ার মিত্ররা রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দুর্বল। পুতিনের যুদ্ধ আকাঙ্ক্ষায় পুরোপুরি সমর্থন দেওয়ায় ইচ্ছা নেই চীনের। স্বৈরশাসনের চেয়ে স্বাধীনতার আবেদন অনেক শক্তিশালী।

বিজয় কোনো পূর্বনির্ধারিত বিষয় নয়। স্বাধীনতাকে রক্ষা করা প্রয়োজন। সামরিক দিকসহ, অন্যান্য সব উপায়ে ইউক্রেনের স্বাধীনতাযোদ্ধাদের সমর্থন করতে হবে। এ বছর মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে ন্যাটোর নেতারা আশ্বাস দেন যে ‘ইউক্রেন, এই যুদ্ধে অবশ্যই জিতবে’। কিন্তু দ্বিধাহীনভাবে পাশে থাকার এই ঘোষণা কি যথেষ্ট? কথার সঙ্গে কাজও এসে তো মিলতে হবে। এখন যেভাবে নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং বিরতি দিয়ে সামরিক সহায়তা করা হচ্ছে, তাতে যুদ্ধক্ষেত্রে অচলাবস্থা ছাড়া আর কিছু বের হয়ে আসা সম্ভব নয়।

গত বছর পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরুর আগপর্যন্ত এ যুদ্ধের প্রতিটি হিসাব-নিকাশ ভুল করেছেন পুতিন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর সেনাবাহিনী অনেক শক্তিশালী, চীন তার নিখাদ মিত্র, পশ্চিমারা বিভক্ত এবং ইউক্রেন খুব তুচ্ছ শক্তির দেশ। এর চেয়ে বড় ভুল আর কিছু হতে পারে না। এখন তাঁর একমাত্র আশা হচ্ছে, সংকল্পের দিক থেকে প্রতিপক্ষের চেয়ে তিনি শক্তিশালী এবং এই আক্রমণ পাল্টা–আক্রমণের যুদ্ধে তিনি অবশ্যই জিতবেন। পুতিন যে ভুল আশা করছেন, সেটা আমাদের আরেকবার প্রমাণ করতে হবে।

ইউক্রেনের জন্য আমাদের ‘সমস্ত’ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইউক্রেনকে যেসব দেশ সহযোগিতা দিচ্ছে সম্মিলিতভাবে তার পরিমাণ অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক, কিন্তু এ মুহূর্তে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই। লড়াই চালিয়ে নেওয়ার জন্য ইউক্রেনের যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদকে প্রয়োজন পুরোটার সরবরাহ করতে হবে এবং পুতিনের এই আগ্রাসী যুদ্ধকে পরাজিত করতে হবে। পুতিন যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন যে এই যুদ্ধে জেতা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তত দ্রুত শান্তি স্থাপন হবে এবং তত তাড়াতাড়ি ইউক্রেনের নাগরিকদের দুর্ভোগ মুক্তি ঘটবে। ট্যাংক, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, সফল পাল্টা আক্রমণ চালানোর মতো যুদ্ধবিমান—সম্মিলিতভাবে এই সবকিছুই দরকার ইউক্রেনের। সেটা দরকার যাতে ইউক্রেনের বিজয় এবং শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে তাদের শর্ত মেনে নেওয়ার পথ তৈরি হয়।

ইউক্রেনের মিত্রদের এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে করে এ যুদ্ধে কিয়েভের বিজয় সুনিশ্চিত হয়।

সম্ভাব্য শান্তি আলোচনার বিষয়টি যখন আলোচিত হচ্ছে, সে সময় এই সংঘাতে চীনের ভূমিকা নিয়ে আমরা সতর্ক না হয়ে পারি না। প্রাণঘাতী নয়, এমন পণ্য সরবরাহ করে এবং উত্তর কোরিয়াকে রাশিয়ায় অস্ত্র সরবরাহ করার অনুমতি দিয়ে বেইজিং পুতিনের যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে সহায়তা করে চলেছে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর জন ম্যাকেইন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, রাশিয়া চীনের ‘গ্যাস স্টেশন’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে চলেছে। তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী অব্যাহতভাবে সত্যে পরিণত হচ্ছে। সি চিন পিংয়ের সাম্প্রতিক সফরে সেই সত্যটি আবার বড় করে সামনে চলে এসেছে। রাশিয়াকে দেখে মনে হয়েছে দেশটি চীনের অধমর্ণ অংশীদার। কিন্তু আমাদের কোনো বিভ্রম থাকা উচিত নয়, পুতিনকে ক্ষমতায় রাখায় চীনের সব ধরনের স্বার্থ রয়েছে।

মস্কো ও বেইজিংকে বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে আটলান্টিকপাড়ের দেশগুলোর বাইরে আমাদের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের অন্য প্রান্তে চীন ও রাশিয়া অনেক দেশের সরকার ও জনগণকে খুব সফলভাবে তাদের বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের নয়া উপনিবেশবাদী ও দ্বিমুখী পররাষ্ট্রনীতিকে দোষ দেয়। একমাত্রিক পদক্ষেপ এখন যথেষ্ট নয়। রাশিয়া ও চীনের অশুভ কর্মকাণ্ডের প্রতি আমাদের মনোযোগটা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় আমাদের মিত্রদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে সংযোগ বাড়াতে হবে। আগের ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। ঠান্ডা যুদ্ধ–পরবর্তী বিশ্বে সরকারের অনেক সংস্থা অকৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির নতুন এই যুগে সফলভাবে প্রতিযোগিতা চালাতে গেলে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলো ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী ও বাণিজ্য সংস্থাগুলোও সংস্কার করতে হবে।

পুতিন ইউক্রেনে তার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে শুরু করেছিলেন যে কয়েক সপ্তাহের মধ্য ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে পারবেন তিনি। এক বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেন যে ঐক্য ও সহনশীলতা দেখিয়ে চলেছে তাতে দেশটি অবিস্মরণীয় শক্তির পরিচয় দিয়েছে। একটি সাম্রাজ্য শাসন করা ছাড়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুতিন একঘরে হয়ে পড়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া এবং পুতিনকে পরাজিত করার জন্য ইউক্রেনের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন। ইউক্রেনের মিত্রদের এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে করে এ যুদ্ধে কিয়েভের বিজয় সুনিশ্চিত হয়। স্বৈরশাসনের চেয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আরও ভালোভাবে সজ্জিত হলেই সেটা অর্জন সম্ভব।

সিমন ম্যাকডোনাল্ড, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের কূটনৈতিক উপদেষ্টা
ক্রিসটফ হিউজজেন, মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের চেয়ার
স্টেফান আব্রিয়াল, ফ্রান্সের বিমানবাহিনীর সাবেক চিফ অব স্টাফ
জিম জোন্স, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
স্টেফানো স্টেফানিনি, আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে