নিউইয়র্কে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ও বিশিষ্ট শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী গুরপাতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার জন্য নিখিল গুপ্ত নামের ৫২ বছর বয়সী মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীকে যুক্তরাষ্ট্র অভিযুক্ত করেছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ভারতের একজন সরকারি কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডটি সংঘটনের জন্য নিখিল গুপ্তকে অর্থ সরবরাহ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের ওপর কালো ছায়া ফেলেছে। একই সঙ্গে ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিকেও এটি প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
একই ধরনের ঘটনা আমরা আগেও দেখেছি। কয়েক মাস আগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কানাডার মাটিতে দুর্বৃত্তের গুলিতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ও কানাডীয় নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জর নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের জড়িত থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ তুলেছিলেন। এরপর ভারত সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল এবং কানাডাকে নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত ৪১ জন কানাডীয় কূটনীতিককে প্রত্যাহার করতে বলেছিল।
নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভারতের হাত আছে বলে ট্রুডো যদিও প্রমাণপত্র হাজির করতে পারেননি; কিন্তু নিউইয়র্কের পান্নুন হত্যার ষড়যন্ত্র বিষয়ে মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয় আদালতে সাক্ষী–সাবুদ হাজির করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লিতে থাকা একজন সরকারি কর্মকর্তা শিখ নেতা পান্নুনকে হত্যা করার জন্য আমেরিকায় থাকা নিখিল গুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিখিল গুপ্ত দিল্লির ওই কর্মকর্তার সঙ্গে পরিকল্পনা করে আমেরিকায় একজন খুনিকে ভাড়া করেন।
এ অভিযোগের সমর্থনে যতগুলো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে একটি ভিডিওচিত্র আছে। অভিযোগের বিবরণে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লি থেকে যে কর্মকর্তা নিখিল গুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তিনি গুপ্তকে একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছিলেন। ওই ক্লিপে নিজ্জরের (কানাডায় দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত শিখ নেতা নিজ্জর) রক্তাক্ত দেহ গাড়িতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
নিখিল গুপ্ত ক্লিপটি অসতর্কতাবশত তাঁর ভাড়া করা খুনিকে শেয়ার করেছিলেন। খুন করার জন্য যাঁকে ভাড়া করা হয়েছিল, তিনি আদতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ডিইএ) একজন গোপন এজেন্ট। এই খুনের পরিকল্পনার বিষয়ে বিশদ তথ্যপ্রমাণ পেতে নিখিল গুপ্তকে তিনি আসল পরিচয় গোপন করে ফাঁদে ফেলেন।
নিজের দেশের জনগণের জানমাল রক্ষায় মোদি যেকোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এমনকি বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার মিশন পরিচালনায়ও তিনি পিছপা হবেন না—ভারতের ভোটারদের মধ্যে এ ধরনের একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে মোদির সরকার এসব গুপ্তহত্যা ‘প্রকল্প’ চালাচ্ছে—কেউ কেউ এমন ধারণাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
ওই গোপন এজেন্টের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ, নিখিল গুপ্ত তাঁর জালে ধরা দিয়ে এত সব তথ্যপ্রমাণ রেখে গেছেন যে এসব তথ্যপ্রমাণ এই চক্রান্তে যুক্ত সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট। এ ঘটনা নানা কারণে তাৎপর্য বহন করে।
প্রথম কথা হলো, এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যাপক প্রচারিত অগ্রাধিকারমূলক বিষয়ের সঙ্গে একেবারেই অসংগতিপূর্ণ। মোদির সরকার ধারাবাহিকভাবে ভারতকে একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তি, জি-২০ সংগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতা হিসেবে প্রচার করে আসছে। মোদি বারবার সগৌরবে ভারতবাসীকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। সর্বশেষ এ ঘটনা ভারতের এসব দাবিকে কমজোরি করে ফেলবে।
অন্যদিকে চীনের আগ্রাসন ঠেকাতে অংশীদার দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা রয়েছে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বন্ধুদেশের নাগরিকদের গুপ্তহত্যার চক্রান্ত করা, তাদের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করা, আইনের শাসন ভাঙা—এসব অভিযোগে জড়িয়ে পড়ায় ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি সন্দেহাতীতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নিজের দেশের জনগণের জানমাল রক্ষায় মোদি যেকোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এমনকি বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার মিশন পরিচালনায়ও তিনি পিছপা হবেন না—ভারতের ভোটারদের মধ্যে এ ধরনের একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে মোদির সরকার এসব গুপ্তহত্যা ‘প্রকল্প’ চালাচ্ছে—কেউ কেউ এমন ধারণাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
এখন প্রশ্ন হলো, ভারত সরকারের মধ্যে থাকা লোকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভোটারদের কাছে মোদি সরকারের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেই এই কাজ করছেন?
ঘটনা হলো, নিখিল গুপ্ত প্রশিক্ষিত চর নন, এমনকি অপরাধী হিসেবে খুব একটা ধূর্তও নন। এতে মনে করা যেতে পারে, এই গুপ্তহত্যার আদেশ খুব উঁচু স্তর থেকে আসেনি।
নিখিল গুপ্তর এই মামলা আরও একটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তান আন্দোলন এখন আর তেমন জোরালো কোনো আন্দোলন নয়। ভারতে এর কোনো তৎপরতা নেই।
বিদেশের মাটিতে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন এই আন্দোলন পরিচালনা করছেন। তাঁরা ভারত সরকারের জন্য তেমন কোনো হুমকি নন।
এ কারণে আন্দাজ করা যেতে পারে, নিখিল গুপ্তকে দিল্লিতে থাকা যে কর্মকর্তা (যুক্তরাষ্ট্র যাঁর নাম প্রকাশ করেনি) ঠিক করেছিলেন, তিনি সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে খুশি করতে নয়, বরং ক্ষমতার কাছে থাকা ‘কঠোর লোকদের’ আশীর্বাদপুষ্ট হতেই এই পরিকল্পনা করে থাকতে পারেন।
ঘটনা যা-ই হোক, দিল্লিকে এ বিষয়ে নড়েচড়ে বসতেই হবে। কাউকে না কাউকে এর দায় হয়তো নিতে হবে। আর বৈশ্বিক সম্পর্কের কথা চিন্তা করে হলেও এ অভিযোগের বিষয়ে নয়াদিল্লিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে এসব ঘটনা তদন্ত করে দেখতে হবে।
● শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, যিনি বর্তমানে দেশটির কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত