মতামত

সবাই কেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক হতে চায়?

নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

পাঁচ বছর পর দেশে জাতীয় নির্বাচন এলেই সরকারে থাকা অথবা বিরোধী দলগুলোর তৎপরতা যেমন বাড়ে, তার সঙ্গে কিছু অত্যুত্সাহী গোষ্ঠী এবং পরিচিত ও অপরিচিত বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতাও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংগঠনের তৎপরতা অনেক বাড়ে।

আমাদের দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা বেশি দিনের নয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন থেকেই মূলত পর্যবেক্ষণ শুরু। দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা যেসব সংস্থার রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ফেমা, ব্রতী, অধিকার, জানিপপ ও ডেমক্রেসিওয়াচ। এ কয়েকটি সংগঠন সার্ক অঞ্চলে ও পূর্ব এশিয়ায়ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। সব কটি সংস্থা এশিয়া ফাউন্ডেশনের ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের তত্ত্বাবধানে ও অর্থায়নে কাজ করেছিল।

তাদের সঙ্গে ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনডিআই (বর্তমানে ডিআই), আইআরআই (ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট)। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এসব সংস্থাকে প্রাক্‌–নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও ভোটার সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে যুক্ত করা হয়েছিল এশিয়া ফাউন্ডেশনকে।

জাতীয় নির্বাচনে দেশীয় বা স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে বিদেশি সংগঠন থেকেও পর্যবেক্ষক আসেন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিদেশি পর্যবেক্ষকদের তেমন দেখা যায়নি। অতীতে যেসব বিদেশি পর্যবেক্ষক বাংলাদেশে এসেছেন, তাঁরা বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি অর্থায়ন পেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যেসব পর্যবেক্ষক দল ২০০৮ সালের নির্বাচনে এসেছিল, তার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, আইআরআই, এনডিআই, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টের ‘কার্টার সেন্টার’ ও আনফ্রেল উল্লেখযোগ্য। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক দল লম্বা সময়ের জন্য, কোনো কোনো দল আবার স্বল্প সময়ের জন্য এসেছিল।

এর পরের দুটি নির্বাচনে দেশের প্রতিষ্ঠিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো পর্যবেক্ষক দলের তেমন উপস্থিতি ছিল না। কারণ, এসব সংস্থার প্রাক্‌–পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ইতিবাচক ছিল না। তবে স্থানীয় দূতাবাসের স্থানীয় কর্মকর্তারা এবং সার্ক থেকে বিশেষভাবে কমিশনের আমন্ত্রণে কিছু কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদানে ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কিছু সংগঠন ইতিমধ্যে প্রাক্‌–নির্বাচন সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। তবে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। পরিবেশ পর্যবেক্ষণের পর দূতাবাসের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা হয়তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

পরিশেষে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ, ২০০৮ সালে স্থানীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধনের যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেটি আবার খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নির্বাচনের প্রাক্কালে গজিয়ে ওঠা পর্যবেক্ষক দলগুলোকে নিবন্ধন প্রদানের আগে তাদের অর্থায়নের বিষয়টি স্বচ্ছ নীতিমালার আওতায় আনতে হবে।

২০১৮ সালে দুটি প্রতিষ্ঠিত সংগঠন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেও নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে তারা অপারগতা জানিয়েছিল। তবে সার্ক দেশগুলোর কয়েকজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এসেছিলেন। একইভাবে বেশ কিছু স্থানীয় সংগঠনকে পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে এমন একটি সংগঠনও ছিল, যেটিতে কয়েকজন অনভিজ্ঞ বিদেশি ব্যক্তিকে যুক্ত করা হয়েছিল। তঁাদের ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত।

মাত্র কিছুদিন আগে একই আদলে কথিত ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’ নামের একটি পর্যবেক্ষক দল নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নির্বাচন নিয়ে তাদের আগাম বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহল ও গণমাধ্যমে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়। সংগঠনের সদস্যদের অতীত পরিচয় এবং তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

আলোচিত সংগঠনের নামেও বিভ্রান্তি রয়েছে। নির্বাচন ‘মনিটরিং’ (কর্তৃত্বপ্রাপ্ত) আর ‘অবজারভেশন’ (পর্যবেক্ষণ) এক নয়। ইলেকশন অবজারভার বা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কর্তব্য নির্বাচন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য প্রকাশ না করা। এর মানে যে নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অনিয়ম বা কারচুপি রোধ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়। শুধু নির্বাচন-উত্তর সময়ে নিজ নিজ সংগঠনের হয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন তারা করতে পারে। তাদের কাজ হলো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গণতান্ত্রিক আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মান নিরূপণে সহায়তা করা। তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো দেশের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য কিংবা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রশ্ন ওঠে।

স্থানীয় পর্যবেক্ষকদেরও কার্যপদ্ধতি প্রায় একই রকমের। কাজেই পর্যবেক্ষকেরা কোনোভাবেই নির্বাচনে কারচুপি অথবা ব্যত্যয় প্রতিরোধ বা তাত্ক্ষণিকভাবে অভিযোগ দায়ের করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়। নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণ নীতিমালায় এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। এ পর্যবেক্ষণ শুধু ভবিষ্যতের করণীয় ও নির্বাচনের মান নিয়ে কমিশনের বিচার-বিবেচনার জন্য। নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক নিবন্ধনের নীতিমালায় এ প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে নির্বাচন পর্যেবেক্ষণ নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। বস্তুতপক্ষে পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা প্রদান করে না। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক স্থানীয় অথবা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণ গ্রহণ করা বা না করার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। তবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল ও তাদের প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশাল গুরুত্ব বহন করে।

পর্যবেক্ষক দলের বা সংগঠনের অর্থায়ন একটি বড় বিষয়। বিশেষ করে দেশি পর্যবেক্ষক সংগঠনের আর্থিক ব্যবস্থাপনা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যদিও পর্যবেক্ষক নিবন্ধন নীতিমালায় এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে আমি মনে করি, এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের পর্যাপ্ত লোকবল জোগাড় করতে হয়। পর্যবেক্ষণের সময়কালে এসব জনবলকে প্রতিদিনের ভাতাসহ যাতায়াত ও প্রয়োজনে বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়। কাজেই অর্থায়নের উৎস এবং বাজেটের আকার ও সক্ষমতার বিষয়টি অবশ্যই পরিষ্কার হওয়া বাঞ্ছনীয়।

স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের অর্থায়ন মূলত দুই উত্স থেকে প্রাপ্ত হয়। একসময় ইডব্লিউজির সঙ্গে নথিভুক্ত সংগঠনগুলো এশিয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ইউএসএআইডি থেকে অর্থ বরাদ্দ পেত। বর্তমানে ইডব্লিউজি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে যথেষ্ট উত্সাহী মনে হয় না অথবা কার্যক্রম নেই। অপর অর্থায়নের উত্স দেশে মার্কিন দুটি সংস্থার মাধ্যমে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এ উৎস থেকে অর্থায়নের নিশ্চয়তা আছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। অনেক সময় স্থানীয় সংগঠনগুলো বিদেশ থেকে সরাসরি অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে এনজিও ব্যুরোর সনদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মোটামুটি উল্লিখিত উত্স ছাড়া দেশীয় সংস্থায় অর্থায়ন নিয়ে রহস্য থেকেই যায়।

আমি মনে করি, প্রার্থী এবং দলের প্রাক্‌–বাজেটের বিবরণ ও নির্বাচনের পরে হিসাব দাখিল করা যেমন অবশ্যকরণীয়, তেমনি দেশীয় পর্যবেক্ষকদের তহবিলের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার জন্য নিবন্ধন নীতিতে এ–সংক্রান্ত বিধান রাখা আবশ্যক। অর্থায়নের বিষয়ের সঙ্গে সম্ভাব্য জনবল উল্লেখ করাটাও জরুরি। অভিজ্ঞতা ও নিরীক্ষণের আলোকে আমার কাছে মনে হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে পর্যবেক্ষণের নামে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের একত্র করে বিভিন্ন উদ্দেশে্য কথিত পর্যবেক্ষক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

শেষ করার আগে ‘অবজারভেশন’ আর ‘মনিটরিং’-এর পার্থক্যটি উল্লেখ করতে চাই। পর্যবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষক সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন ‘মনিটর’ (বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত) মানে যাদের নির্বাচন চলাকালীন কমিশন কর্তৃক অথবা কমিশনের তত্ত্বাবধানে আইন দ্বারা, নির্বাচনের কোনো পর্যায়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া বা সুপারিশের ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং ব্যত্যয়ের লিখিত বিবরণ কমিশনে উপস্থাপন করতে পারে।

বিশ্বের অনেক দেশে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমেই নির্বাচন মনিটরিং সেল নিয়োজিত হয়। কাজেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে ‘মনিটরিং’ শব্দ ব্যবহার যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।

পরিশেষে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ, ২০০৮ সালে স্থানীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধনের যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেটি আবার খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নির্বাচনের প্রাক্কালে গজিয়ে ওঠা পর্যবেক্ষক দলগুলোকে নিবন্ধন প্রদানের আগে তাদের অর্থায়নের বিষয়টি স্বচ্ছ নীতিমালার আওতায় আনতে হবে।

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

  • hhintlbd@yahoo.com