মতামত

বিষ ছিটিয়ে ডেঙ্গুকে বশীভূত করা যাবে না

ডেঙ্গুর মতো শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, না চলে গিয়েছে—কোনটা বললে কতটা হক কথা হবে? আর কতটা বাড়িয়ে বলা হবে? এসব নিয়ে রাতের পর রাত টক শো চলতে পারে কিন্তু পরিসংখ্যান যে আমাদের সব প্রচেষ্টা নিয়ে ঠাট্টা করছে, সেটা মানতেই হবে।

বলতে গেলে সারা দেশেই এখন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। যে চার–পাঁচটি জেলা এখনো ডেঙ্গু মানচিত্রে জায়গা পায়নি, তাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। আমরা জানি, হাসপাতালে সব রোগী আসে না, তাই হাসপাতালকেন্দ্রিক তথ্য, সব তথ্যের একটি অংশমাত্র।

ইতিমধ্যে এক দিনে হাসপাতালে সর্বোচ্চ ভর্তি আর সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় (৯ জুলাই) হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৮৩৬ জন আর মারা গেছেন ছয়জন (এঁদের মধ্যে চারজনই নারী)। এ বছর এক দিনে এত পরিমাণ রোগী ও মৃত্যু আগে দেখা যায়নি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এর আগে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছিলেন শনিবার (৮ জুলাই)—৮২০ জন। আর এক দিনে সর্বাধিক পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল ৪ জুলাই বুধবার।

একেক স্থানের মশার জন্য একেক ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন সব জায়গায় একই ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। মশার উপদ্রব বাড়ার এটিও একটি কারণ

দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ তাঁর পর্যবেক্ষণের আলোকে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘সামান্য জ্বর, কাশি ভেবে ডেঙ্গুকে প্রথমে গুরুত্ব দিচ্ছে না পাবলিক, দেখা যাচ্ছে তারা আসলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

ফলে যারা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্ত হচ্ছে, তারা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের মধ্যে পড়ছে।’ আদতে এখনকার ডেঙ্গুর সঙ্গে ২০০০ সালের এমনকি ২০১২ সালের ডেঙ্গুর আলামত আচরণ এবং সংক্রমণ শক্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক। ফলে আগের অভিজ্ঞতার আয়নায় ডেঙ্গুকে চেনা যাচ্ছে না।

এখন আগের মতো জ্বরের পারদ চড়ে যাচ্ছে না। বিরতি দিচ্ছে। শরীরে ব্যথা তেমন থাকছে না। প্লাটিলেট কমে গেলেও টের পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে মনে হবে সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা বা গলাব্যথা। তবে চট করেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। কমে যাচ্ছে রক্তচাপ, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, যা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নামে পরিচিত।

এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হওয়ার অন্যতম কারণও শক সিনড্রোম। ৭ জুলাই প্রথম আলোর মানসুরা হোসাইন ডেঙ্গুর শিকার আট বছরের শিশু আহনাফের বাবার যে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, ‘ছেলেটা মঙ্গলবারও হাসপাতালে হাসল, খেলল আর এখন তার জানাজা হবে’—আচমকা চপেটাঘাতের মতো সেটাই এখন ঘটছে আশপাশে।

অচেনা হয়ে গেছে ২৩ বছরের চেনা রোগটি। একজন হতবাক মা বললেন, সাপে কাটলে মানুষ বাঁচে আর সামান্য মশা কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক জীবন। প্রতি চারজন ডেঙ্গু রোগীর একজন এখন শিশু। সরকারি হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর ডেঙ্গুতে যে ৭৩ জন মারা গেছেন, তার মধ্যে ২৪ জনই শিশু। শিশু হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন হতবাক সেই মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সন্ধ্যার আগে আগে তখন দূর থেকে ভেসে আসছিল মশা মারা মেশিনের আওয়াজ আর বিষের ঝাঁজালো গন্ধ। ওই মা বললেন, ‘মরা মানুষের মুখে পানি পড়া দিয়ে কী লাভ!’ স্বগতোক্তির মতো অস্ফুট শোনা গেল তাঁর কথাগুলো। কথাগুলো তিনি ফগার মেশিনের উদ্দেশেই বলেছিলেন।

কীটতত্ত্ববিদেরাও বলছেন, মশা কম থাকলে মশা মারার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সেটাই মোক্ষম সময়। কিন্তু যখন মশা বেড়ে যায় বা মশার যন্ত্রণায় জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন নেওয়া হয় মশা নিয়ন্ত্রণের চটজলদি কর্মসূচি বা ক্রাশ প্রোগ্রাম। ভুল সময়ে ভুলভাবে নেওয়া এসব লোকদেখানো ছবি ওঠানো কর্মসূচিতে লাভ হয় সামান্যই। মেয়র আতিক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেটা স্বীকার করেই বলেছিলেন, ‘মশা নিধনে আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা ধ্বংস হয়নি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।’

সিটি করপোরেশনগুলোর ‘সব অসুখের একই ওষুধ’ মার্কা নীতি নিয়েও ভাবার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বারবার একই বিষ প্রয়োগের ফলে মশার দেহে সহনক্ষমতা বেড়ে যায়। প্রতিটি প্রাণী দেহেই প্রকৃতিগতভাবে এ সহনক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে উচ্চমাত্রার কীটনাশক ছিটানোর পরও সহনক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে এখন আর আগের মতো মশা মরছে না। তা ছাড়া একেক স্থানের মশার জন্য একেক ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন সব জায়গায় একই ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। মশার উপদ্রব বাড়ার এটিও একটি কারণ।

কোন পথে হাঁটলে বিপদ কমবে

সমন্বয় বা মিলেমিশে কাজ করার ইচ্ছা আমাদের খাসলতের পরিপন্থী। কাজেই সমন্বয়ের গান গেয়ে আমরা বেশি দূর এগোতে পারব না। পাকিস্তানের কালে ম্যালেরিয়া দূর করার জন্য এ দেশে আলাদা একটা কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল।

ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি নামের সেই কর্তৃপক্ষ সারা দেশে অফিস খুলে সারা বছর কাজ করত। সহায়তা দিত ইউএসএআইডি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর জাতিসংঘের শিশু তহবিল। অনেক ভুলত্রুটি আর বিষ ডিটিটির যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের অনেক ক্ষতির কারণ হলেও ম্যালেরিয়া কিন্তু দূর হয়েছিল।

বছরব্যাপী বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়িত করতে হলে আমাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আলাদা একটা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতেই হবে। মোদ্দাকথা, ডেঙ্গু নির্মূলে বড় বিনিয়োগ আর বড় পদক্ষেপ প্রয়োজন। যেখানে বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ ও চিকিৎসক একসঙ্গে বসে কাজ করতে পারবেন।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

    ই–মেইল: nayeem5508@gmail.com