ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকী

দায়িত্ব পেলে কি জিন–ভূত ভর করে

প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পাওয়ার আগে অনেকে নানা বিপ্লবী কথা, সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে সরব থাকেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁদের মধ্যে সেই গতিশীলতা, বুদ্ধিদীপ্ততা ও বিচক্ষণতা আর দেখতে পাওয়া যায় না। রাজনীতিবিদ, আমলা, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কিংবা কলাম লেখক—এ বিষয়ে কারোর ক্ষেত্রেই তেমন ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় না। রাজনৈতিক সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারসহ সব আমলেই এমনটি দেখা যায়।

জাদুতে আবিষ্ট হলে যেমন বিচক্ষণ ব্যক্তির স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পায়, এ–ও যেন তেমন। আবার জিন–ভূত ভর করলে যেমন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, দায়িত্বের চেয়ারে বসলে অনেকের ক্ষেত্রে তেমনটিই হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে কে সেই জিন–ভূত বা জাদুকর? আর জাদুমন্ত্রই-বা কী?

দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জাদুতে আবিষ্ট হওয়া ও জিনের আসর ভর করা থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় আছে? ঝাড়ফুঁকে এই আবেশ কিংবা ভর কাটানো সম্ভব নয়। তবে দায়িত্বের চেয়ারে বসার পর যেন কেউ জাদুতে আবিষ্ট না হন কিংবা কারও ওপর জিনের আসর ভর না করে, তা প্রতিরোধের সুযোগ আছে।

সম্ভবত জাদুমন্ত্র হলো দেশের ঔপনিবেশিক ধাঁচের আইনকানুন। ‘চেক ও ব্যালান্স’ করার অভিপ্রায়ে তৈরি এসব আইনকানুন মূলত চুরি ঠেকানোর প্রচেষ্টারই অংশ। তবে এসবের ফাঁকফোকর দিয়ে পুকুরচুরি থেকে দেশ পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা যায়। এসব আইন বজায় রেখে বৈপ্লবিক বা আমূল পরিবর্তন করার সুযোগ কম। অন্যদিকে আমূল পরিবর্তন করার জন্য যে যোগ্যতা, আত্মবিশ্বাস ও সাহস থাকা দরকার, তা–ও সহজে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া রুটিন কাজের বাইরে বৈপ্লবিক কিছু করতে গেলে দপ্তর অনেক ক্ষেত্রেই বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এর মূলে রয়েছে দপ্তরের লোকজনের সক্ষমতার অভাব ও কর্মে অনীহা। এর অন্যতম কারণ, সক্ষমতা বা দক্ষতার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পদায়ন কিংবা পদোন্নতি হয় না; হয় তেলবাজি ও দলবাজির জোরে কিংবা অর্থের বিনিময়ে। আবার কোনো দপ্তরে সক্ষম ব্যক্তিরা কাজের চাপে নুয়ে পড়ে উৎকর্ষ ধরে রাখতে পারেন না। দপ্তরের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না থাকায় দপ্তরপ্রধানকেই সব দায়দায়িত্ব নিতে হয়।

কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, দপ্তরপ্রধান (যেমন মন্ত্রী, সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে সুপার পারসন ভাবেন। স্বার্থান্বেষী ও তোষামোদি চক্র তাঁদের এ ভাবনাকে আরও পাকাপোক্ত করে। তাঁরা অন্যের মতামত গ্রহণ করেন না। নিজের খণ্ডিত উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে মনগড়া বিষয় তাঁরা চাপিয়ে দেন। অন্যদিকে দায়িত্বের চেয়ারে বসার পর তোষামোদি ও তদবির চক্রের ব্যূহ ভেদ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। আমাদের বেশির ভাগ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না।

এ বিষয়ের সঙ্গে মিনি মাছ-সম্পর্কিত একটি গল্পের মিল আছে। মিনি মাছ নিরীহ গোছের মাছ। আকারে ছোট। কিন্তু এর মুখ হাঁ করলে অনেক বড় হয়ে যায়। নিরীহ মিনি মাছ জেলের জালে প্রায়ই আটকে যায়। মিনি মাছকে জেলের জালে আটকানো থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে মাছেরা একদিন বৈঠকে বসে। তারা মিনি মাছদের জিজ্ঞাসা করল, আমাদের বড় বড় শিং, তবু আমরা তো জালে আটকাই না? তোমাদের কোনো শিং নেই তবু তোমরা কেন জালে আটকাও? জবাবে মিনি মাছ বলল, জালের কাছে গেলে জালের ছোট ছোট ছিদ্র দেখে আমাদের হাসি আসে, তখন জালের ফাঁদের কথা ভুলে গিয়ে মুখ হাঁ করে বড় করতেই জালে আটকা পড়ি।

দায়িত্বের চেয়ারে বসার পর আমাদের অনেকেই মিনি মাছের দশায় পড়েন। অর্থাৎ দায়িত্বের চেয়ারে বসার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঔপনিবেশিক ধাঁচের আইনকানুন, আমলাতন্ত্র, তোষামোদি ও তদবির চক্রের ছোট-বড় ছিদ্রওয়ালা মায়াজালে আটকা পড়েন। নিজস্ব স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারায় অনেকেই কোনো এক সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।

চেয়ারে বসার পর ক্ষমতার জিন–ভূত আসর করলে নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে থাকে না। দেশি কিংবা বিদেশি কারোর সুপারিশ বা আশীর্বাদে কেউ চেয়ারে আসীন হলে তাঁর নিজের মতো কাজ করার সুযোগ থাকে না। তখন সুপারিশকারী ব্যক্তি নিজের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তি অযোগ্য হলে কায়েমি স্বার্থবাদীদের স্বার্থ চরিতার্থ করা সহজ হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ করা বেশ সহজ। আর দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদীরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে সিদ্ধহস্ত।

আবার এ দেশে আমরা সবাই সহজে বিক্রি হয়ে যেতে পারি। দু-একজন যারা পয়সায় বিক্রি হই না, তারা ভয়ে বিক্রি হই। এই ভয় হলো গুম হওয়ার ভয়, আয়নাঘরের ভয়, ব্ল্যাকমেল বা মিথ্যা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাওয়ার ভয় কিংবা ছেলেমেয়েকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয়। যেভাবেই বিক্রি হই, তখন নিয়ন্ত্রণ তো আর নিজের কাছে থাকে না।

দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জাদুতে আবিষ্ট হওয়া ও জিন–ভূতের আসর ভর করা থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় আছে? ঝাড়ফুঁকে এই আবেশ কিংবা ভর কাটানো সম্ভব নয়। তবে দায়িত্বের চেয়ারে বসার পর যেন কেউ জাদুতে আবিষ্ট না হন কিংবা কারও ওপর জিন–ভূতের আসর ভর না করে, তা প্রতিরোধের সুযোগ আছে। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার ঔপনিবেশিক ধাঁচের আইনকানুনের পরিবর্তন ও কায়েমি স্বার্থবাদী চক্রের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরবর্তী সময় যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা যুক্তি, বুদ্ধি ও গণমানুষের স্বার্থে কাজ করবেন।

  • ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফরমস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)