ইউক্রেনের উপদ্বীপ ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার মূল ভূমির সংযোগ স্থাপনকারী কার্চ প্রণালির ওপর সেতুটি ১৭ জুলাইয়ের হামলায় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি নৌড্রোন হামলার সফল দৃষ্টান্ত।
এ হামলার ব্যাপারে কিয়েভ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তি দেওয়া হয়নি। কিন্তু জুন মাসের শুরু থেকে ইউক্রেন যে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে, সেই অভিযানে তারা যে রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ লাইনে আঘাত করতে পেরেছে, এটা তারই দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই হামলার প্রতীকী গুরুত্বও অনেক। কেননা, অধিকৃত একটি ভূখণ্ডে রাশিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে এ ড্রোন হামলা।
কার্চ প্রণালির ওপর অবস্থিত সড়ক সেতুটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে সেতু ও সেভাস্তোপল বন্দর লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি হামলা চালানো হয়। কিন্তু সেই হামলাগুলো সফলভাবে নিশানায় আঘাত হানতে পারেনি। সেভাস্তোপল বন্দর কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার নৌবহরের প্রধান ঘাঁটি। ১৭ জুলাইয়ের হামলায় সড়কসেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রেলসেতুটির ক্ষতি হয়নি। তবে সড়কসেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সড়কপথে যোগাযোগে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে আরেকটি হামলায় কার্চ সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময়ের মতো এবারও সেতু সংস্কার করে চালু করবে তারা। কিন্তু সংস্কারের জন্য সময় লাগবে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়ে সাধারণ মানুষের জন্য চলাচল সীমিত হয়ে যাওয়ায় তারা ঠিকই বুঝতে পারছে, এ যুদ্ধে তাদের মূল্য চুকাতে হচ্ছে।
চার সপ্তাহ আগে ইউক্রেন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া চানহার সেতুতেও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। এখানেও সড়ক ও রেলসেতু পাশাপাশি অবস্থিত। চানহার সেতুটি ক্রিমিয়ার সঙ্গে খেরসনের যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
ইউক্রেনের হামলা থেকে ক্রিমিয়াকে রক্ষা করতে পারার বিষয়টি অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের বিরাট দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। তাঁর সরকারের ক্ষমতা নিয়ে যে যে মিথ প্রচলিত, তার মূলে গিয়েও আঘাত করে। এর মানে অবশ্য এই নয় যে ক্রিমিয়া ক্রেমলিনের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেন দাবি করেছে, তারা ঘটনাক্রমে একদিন ক্রিমিয়াকে আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবে। তাদের এই দাবি আরও কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল।
কারও কারও কাছে মনে হতে পারে, কৌশলগত দিক থেকে কম তাৎপর্যসম্পন্ন এসব স্থাপনায় হামলা প্রতীকী হামলা। বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার অধিকৃত এলাকায় বহু প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণ যখন চলছে, তখন এ ধরনের হামলার গুরুত্ব কী, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
কিন্তু এই হামলাকে বড় প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে। রাশিয়ার সরবরাহ রেখা বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্যে এ হামলা করা হয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনে রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পরাস্ত করতে হলে এক হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত সরবরাহ রেখা ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপট থেকে ক্রিমিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কার্চ প্রণালি ও চানহার সেতু দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ ইউক্রেনের যোগাযোগ রক্ষা হয়। মস্কো থেকে দক্ষিণ খেরসন অঞ্চলে রসদ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ।
খেরসন এবং আরও পূর্ব দিকে রাশিয়ার অধিকৃত ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া ও দোনেৎস্ক অঞ্চল ক্রিমিয়ায় সুপেয় পানি সরবরাহ ও সেখানকার খামারশিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত জুন মাসে নোভা কাখোকভা জলবিদ্যুৎ বাঁধ ধ্বংসের পর ক্রিমিয়ার পানির সরবরাহ এমনিতেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
২০১৪ সালের মার্চ মাসে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ অবৈধভাবে দখলে নেওয়ার পর রাশিয়া সেখানে বিপুল সেনা মোতায়েন করে। এরপরও রাশিয়ার সেনারা সেখানে পুতিনবিরোধী একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছ থেকে আক্রমণের সম্মুখীন হয়।
জুন মাসে রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণ শুরুর পর ক্রিমিয়ায় রুশ স্বেচ্ছাসেবক ও আদিবাসী তাতারেরা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে আগস্ট মাসে খেরসন অঞ্চলে রুশ বাহিনী ইউক্রেনীয়দের আক্রমণে যখন পিছু হটেছিল, সে সময়ও ক্রিমিয়ার এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।
পুতিনের দুর্বলতা
এ সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষার জন্য একই ধরনের দুর্বল জায়গা রয়েছে। গত ২২ জুন চানহার সেতু ও ১৭ জুলাই কার্চ প্রণালিতে হামলা এ বিষয়ই সামনে নিয়ে এল।
যে সময়ে এই দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ল, সেটাও প্রতীকীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
একসময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের ব্যর্থ বিদ্রোহের পর পুতিন তাঁর কর্তৃত্ব নতুনভাবে যখন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, সেই সময়েই এটি ঘটেছে। অপরাজেয় ব্যক্তি হিসেবে পুতিনের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, প্রিগোশিনের বিদ্রোহ তাতে কালিমা লেপে দিয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, হামলা হয়েছে ক্রিমিয়াতে। ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল রাশিয়া দখলে নিয়েছে, তার মধ্যে ক্রিমিয়ায় একমাত্র এলাকা, যেখানকার মানুষেরা রুশদের ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছিল।
আরেকটি বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, ঐতিহাসিক দাবির বিষয়টা সরিয়ে রেখেই বলা যায়, ক্রিমিয়া এমন একটি ভূখণ্ড, যেটিকে রাশিয়া খুবই গুরুত্ব দেয়।
ইউক্রেনের হামলা থেকে ক্রিমিয়াকে রক্ষা করতে না পারার বিষয়টি অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের বিরাট দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। তাঁর সরকারের ক্ষমতা নিয়ে যে যে মিথ প্রচলিত, তার মূলে গিয়েও আঘাত করে।
এর মানে অবশ্য এই নয় যে ক্রিমিয়া ক্রেমলিনের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেন দাবি করেছে, তারা ঘটনাক্রমে একদিন ক্রিমিয়াকে আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবে। তাদের এই দাবি আরও কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল।
স্টেফান উলফ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত