আইএস ও আল–কায়েদা থেকে হিজবুল্লাহ ও কুদস ফোর্স, সহিংস বর্ণবাদী এবং উগ্র ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী—এদের প্রত্যেকেই গাজার সহিংসতাকে পুঁজি করছে। এখন পর্যন্ত আমরা ভয়াবহ রক্তপাত প্রত্যক্ষ করেছি। উগ্রবাদী এই গোষ্ঠীগুলো আরও বেশি রক্তপাত আর হানাহানির হুমকি দিচ্ছে এখন।
গত তিন বছরের মধ্যে ইউরোপের মাটিতে এই প্রথম সুইডেনের একজন নাগরিককে গত সপ্তাহে আইএস হত্যা করেছে। পশ্চিমে ইহুদি ও মুসলিমদের ওপর চলমান নিপীড়নের মধ্যে শিকাগোতে খুন হয়েছে ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি–আমেরিকান একটি ছেলে। ছেলেটি তার মায়ের সঙ্গে যে বাড়িতে থাকত, সেই বাড়ির মালিক দুজনকেই উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। এ সময় তিনি ‘তোমরা মুসলিম, তোমাদের অবশ্যই মরতে হবে’ বলে চিৎকার করছিলেন। দুই পক্ষের বেসামরিক জনগণ খুন হওয়ায় যাঁরা সমালোচনা করেছেন, তাঁরা হত্যার হুমকি পেয়েছেন; তাঁদের ইনবক্সগুলো ঘৃণাসূচক ই–মেইলে ভরে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আরও খারাপ কিছু ঘটার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলি অবসরকালীন ভাতাভোগী, নারী ও শিশুদের নির্বিচার খুন করায় আল–কায়েদা আনন্দে আত্মহারা। তারা এই হত্যাযজ্ঞকে আধুনিক ইতিহাসে যত তথাকথিত ইসলামি যুদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে উজ্জ্বলতম বলে অভিহিত করেছে। এর অর্থ হলো এই হামলা তাদের কাছে নাইন–ইলেভেনের ‘জিহাদি’ হামলার চেয়েও গুরুত্ববহ। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যতই হামাসকে ‘আইএস’ বলে আখ্যায়িত করুন না কেন, আদতে আইএস হামাসকে ঘৃণা করে। তারা তাদের যোদ্ধাদের হামাসের সঙ্গে যুক্ত হতে নিষেধ করেছে। কারণ তারা মনে করে হামাস হলো জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মত্যাগী।
আইএস এবং আল–কায়েদার চ্যানেলগুলো এখন পুরোদমে সক্রিয়। ফিলিস্তিনি শিশুদের মরদেহ দেখিয়ে তারা বিক্ষুব্ধ মানুষকে তাদের নারকীয় কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে। আইএসের আল নাবা সংবাদপত্র থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত ইহুদিদের, তাদের প্রার্থনাস্থল এবং পশ্চিমা ও ইসরায়েলি দূতাবাসকে নিশানা করে হামলা চালানোর দাবি করা হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতি উগ্র পশ্চিমাদের ভালোবাসা, ভক্তি ও শর্তহীন সমর্থন, অস্ত্র ও অর্থের প্রতিশ্রুতির খবর জঙ্গিগোষ্ঠী পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী বার্তা পৌঁছাচ্ছে সে সম্পর্কে জো বাইডেন, ঋষি সুনাক বা উরসুলা ভন ডার লিয়েন হয়তো জানেন না। এই গোষ্ঠীগুলো তাদের সমর্থকদের মনে করিয়ে দিতে চাইছে যে পশ্চিম কখনো তাদের মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে চলা ক্রুসেড থেকে সরে আসেনি।
এই বর্বর সন্ত্রাসী প্রচার কার্যক্রম পুঁজি করছে আরব বিশ্বের হতাশা আর বিভ্রান্তিকে। কারণ, আরব বিশ্ব মনে করছে পশ্চিমাদের পক্ষপাত, তাদের বর্ণবাদী আচরণ বদলায়নি। কিছু পশ্চিমা নেতা তাঁদের বক্তব্যে ভারসাম্য রাখার কোনো চেষ্টাই করেন না। তাঁদের বড় অংশ ফিলিস্তিনিদের ওপর চলা গণহত্যাকে স্বীকারই করেন না। যদিও এই নেতাদের মধ্যে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম ল্যানি জলির অবস্থান ছিল সহানুভূতিশীল। তিনি গাজার ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতির কথা বলেন।
ইরান সরকার–সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোও গাজার এই উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে ইরাক, সিরিয়া ও অন্যান্য জায়গায় অবস্থানরত পশ্চিমাদের নিশানা করে হামলা চালানোর চেষ্টা করছে। ইয়েমেন থেকে ছোড়া ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল যুক্তরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় করেছে।
তেহরানের সহায়তাপুষ্ট মিলিশিয়ারা ইসরায়েল-সিরিয়া-লেবানন সীমান্ত এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে। কুদস ফোর্সের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে এখানে একটি বহুজাতিক বাহিনীর কাজ শুরুর কথা, যারা হামাসের সঙ্গে সমন্বয় করে চলবে। লেবানন সীমান্তে আল-হাশদ আল-শাবির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে আল-সুহাদার কমান্ডার আবু আলা আল-ওয়ালাইকে দেখা গেছে।
নেতানিয়াহু হামাসকে নির্মূলের অসম্ভব উদ্দেশ্য নিয়ে যা করছেন তাতে করে শুধু একটা তিতিবিরক্ত প্রজন্ম তৈরি হবে। তারা চেষ্টা চালাবে প্রতিশোধ নেওয়ার। ফিলিস্তিনি রাজনীতিক হানান আশরাবি সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় চালানো এই অভিযান মধ্যমপন্থী ফিলিস্তিনিদের জন্য অবমাননাকর। কারণ, তাঁরা বহু বছর ধরে সংলাপ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সমাধান খুঁজেছেন। এই অভিযান বরং উগ্রবাদিতার পালে জোরেশোরে হাওয়া দেবে।
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, সংক্ষেপে অনূদিত
বারিয়া আলামুদ্দিন মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক