দুই বিঘা জমি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। হাল আমলে বাংলাদেশের ধনীরা চুরি করা ছেড়ে দিয়েছেন। অবাক হবেন না, ভাবছেন তাঁরা সাধু হয়ে গেছেন? ঘটনা তা নয়, চুরিতে এখন আর তাঁদের পোষায় না, সবার চোখের সামনে দিনদুপুরে তাঁরা যেটা করেন, তাকে ডাকাতি বললেও কম বলা হয়। চোরের তবু কিছু চক্ষুলজ্জা থাকে, অন্ধকারে তাঁর কাজ সারতে চান, ধরা পড়ার ভয়ে কাঁচুমাচু করেন। এখনকার ডাকাতদের চক্ষুলজ্জা তো দূরের কথা, কোনো প্রকার লজ্জাই নেই। লজ্জার মাথা নয় শুধু, লেজ পর্যন্ত খেয়ে বসে আছেন তাঁরা। এসব ডাকাতের সবচেয়ে বেশি পছন্দ কাঙালের ধন। এই ধন অনায়াসে লুটে নেওয়া যায়, কেউ কিছু বলে না। কেননা, বলার মতো ক্ষমতাবান তাঁরা আগেও ছিল না, এখনো নেই।
লুটপাটে সহায়তা করার জন্য মুখিয়ে থাকেন প্রচুর লোক। এসব লোক লুটপাটের এই অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে বেগমপাড়া বানানোতে আগ্রহী ক্ষমতাবানদের অভাব হয়নি কয়েক বছর ধরে। শুধু যে বড় বড় ক্ষমতাবান ডাকাতই গরিবের অর্থ লুটে নিচ্ছেন তা নয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ডাকাতেরাও এতে পিছিয়ে নেই। যে যেভাবে পারছেন, দুস্থদের সম্বল নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন।
এই দেশে ক্ষমতাহীন ও গরিব মানুষ ছাড়া দুর্নীতির জন্য অবস্থাপন্ন, ক্ষমতাবান বা রাঘববোয়ালদের কয়জন শাস্তি পেয়েছে? গরিবেরা নিরপরাধ হয়েও শাস্তি পাবে—এমনই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে ঈশ্বরদীর ৩৭ জন প্রান্তিক কৃষকের নামে কেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে? ঋণ পরিশোধ করার পরও ৪০০ থেকে ৯০০ টাকার জন্য তাঁদের অনেককেই কেন জেল খাটতে হবে?
ঢাকার দুই উপজেলা নবাবগঞ্জ ও দোহারে খাসজমি বরাদ্দ পাননি ভূমিহীন ও নিঃস্ব মানুষেরা। বেশির ভাগ খাসজমি নিয়ে নিয়েছেন সচ্ছল ও ধনী লোকেরা। অথচ খাসজমি পাওয়ার যে শর্ত, তাতে বলা হয়েছে, এসব জমি পাবেন ভূমিহীনেরা। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, ভূমিহীনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যে পরিবারের বসতবাড়ি ও কৃষিজমি কিছুই নেই, কিন্তু পরিবারটি কৃষিনির্ভর, তারা ভূমিহীন। এ ছাড়া যে পরিবারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত বসতবাড়ি আছে, কিন্তু কৃষিজমি নেই, সেই পরিবারও ভূমিহীন গণ্য হবে। তবে বসতবাড়ির সঙ্গে কৃষিজমি থাকলে তারা ভূমিহীন হিসেবে খাসজমি পাবে না।’
এসব গেল কাগজ–কলমের কথা। কিন্তু কাজির গরু কিতাবেই থাকে, গোয়ালে নয়। ভূমিহীন হতে হলেও তাই টাকা লাগছে। যার যত টাকা, সে তত ‘ভূমিহীন’। নিজেকে ভূমিহীন দেখানোর দৌড়ে এগিয়ে আছেন সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, প্রবাসী থেকে শুরু করে সাংবাদিক পর্যন্ত। তাঁরাই পেয়েছেন খাসজমি। কেননা, টাকা ছাড়া তা মেলে না। আর প্রকৃত ভূমিহীনদের টাকা নেই। নবাবগঞ্জের হায়াতকান্দা গ্রামের অটোচালক আবুল কালাম অনেক ক্ষোভ নিয়ে বলেছেন, ‘যাদের টাকা আছে, তারাই জমি পায়। যাদের টাকা নাই, তাদের জমিও নাই।’ রাস্তার পাশে টিনের ছাপরায় থাকা নিঃস্ব আবুল কালাম তাই আবেদন করেও জমি পাননি।
ভূমিহীন হিসেবে খাসজমি পেয়েছেন দোহারের মাহমুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (সদ্য সাবেক) তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে, মেয়ে, ভাই, জামাইসহ অন্তত ২০ জন আত্মীয়। অথচ এই ‘ভূমিহীন’ তোফাজ্জল হোসেনের পারিবারিক বসতবাড়িটাই ৭০ বিঘা নিয়ে। ৭০ বিঘার চেয়ে ১০ শতাংশ কত গুণ বেশি, সেই হিসাব পাঠক জানলেও ভূমি অফিসের লোকজন হয়তো জানেন না। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় নিঃস্ব উপেনের সর্বশেষ সম্বল জমিটুকু জমিদার বাবু নিতে চেয়েছিলেন তাঁর বাগানের সৌন্দর্য বাড়ানোর দরকারে। দোহারের জমিদারেরও তেমন প্রয়োজন হয়ে থাকবে হয়তো।
আরেক ‘ভূমিহীন’ পরিবারের প্রধান হোসেন মৃধা। তিনি যে গ্রামে থাকেন, সেটার নামও তাঁর নামে—হোসেনপুর। তিনি জানিয়েছেন তাঁর বসতবাড়ি ও ফসলি জমি আছে। তবু ‘ভূমিহীন’ হিসেবে তাঁর তিন ছেলেই পেয়েছে খাসজমির বরাদ্দ। এভাবে দুই উপজেলার সচ্ছল এবং একতলা-দোতলা বাড়ির ‘ভূমিহীন’ মালিকেরা খাসজমির বরাদ্দ বাগিয়ে নিয়েছে। নিতান্তই চোখে লাগে বলে হয়তো কয়েকজন প্রকৃত গরিব মানুষকে কিছু খাসজমি দেওয়া হয়েছে এই দুই উপজেলায়।
দোহার উপজেলায় গত তিন বছরে ১০৯ জনকে ভূমিহীন হিসেবে খাসজমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭ জনের তালিকা খতিয়ে দেখা যায়, অনেকেরই স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ কম নয়। অন্যদের ব্যাপারে খোঁজ নিলে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাহলে এই অনিয়মের কী উত্তর দেবে ভূমি অফিস? তারা কি কোনো কিছু খোঁজখবর না নিয়ে নিজেদের ‘ভূমিহীন’ দাবি করা লোকেদের জমি বরাদ্দ দিয়ে দিয়েছিল? নাকি তারা স্বীকার করবে, অর্থের বিনিময়ে প্রকৃত ভূমিহীনদের তারা বঞ্চিত করেছে। সম্প্রতি অবশ্য এ অনিয়মের তদন্ত শুরু হয়েছে। বলা হয়েছে, তদন্তে যদি বেরিয়ে আসে তারা আসলেই ভূমিহীন নয়, তাহলে বরাদ্দ বাতিল করা হবে। কিন্তু ভূমি অফিসের যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এমন ব্যবস্থা নিতে থাকলে ঠক বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে না তো?
এর আগে ২০১৮ সালে বরিশাল সদরের চরবাড়িয়ে ইউনিয়নেও এমন অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে। কী সমাধান করতে পেরেছে সরকার? সেখানকার ভূমি অফিসের অসাধু কর্মচারীদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা গেছে কি? নিদেনপক্ষে জমিগুলো কি উদ্ধার করা গেছে? সারা দেশে প্রায় ৪২ লাখ একর খাসজমি রয়েছে। এসবের মধ্যে প্রচুর খাসজমি বেদখল হয়ে আছে, যার প্রকৃত দাবিদার ভূমিহীনেরা। ভূমি অফিসের অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া যে এটা সম্ভব নয়, সে কথা বোঝার জন্য খোঁজ নেওয়ার মতো পরিশ্রম না করলেও চলে।
এই দেশে ক্ষমতাহীন ও গরিব মানুষ ছাড়া দুর্নীতির জন্য অবস্থাপন্ন, ক্ষমতাবান বা রাঘববোয়ালদের কয়জন শাস্তি পেয়েছে? গরিবেরা নিরপরাধ হয়েও শাস্তি পাবে—এমনই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে ঈশ্বরদীর ৩৭ জন প্রান্তিক কৃষকের নামে কেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে? ঋণ পরিশোধ করার পরও ৪০০ থেকে ৯০০ টাকার জন্য তাঁদের অনেককেই কেন জেল খাটতে হবে? গরিবের ওপর জুলুম, অধিকার হরণ আর ধনীদের তোষণই কি হয়ে উঠছে আমাদের সংস্কৃতি?
মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
mehedirasel32@gmail.com