সহকর্মী মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোয় তাঁর পাঁচ পর্বের লেখায় ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু দলটি নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতে কিছু আসনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়নি।
কিছু আসনে বিরোধী দলের জয়কেও ছিনিয়ে নেওয়া হয় জবরদস্তি করে। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল হলো: আওয়ামী লীগ ২৯৩, জাসদ ১, জাতীয় লীগ ১, স্বতন্ত্র ৫।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল জবরদস্তি না করলে হয়তো রাজনীতির গতিপথ ভিন্ন হতো।
এরপর দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ ততটুকু দিয়েছেন, যতটুকু দিলে নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ থাকে।
সেই নির্বাচনে সদ্য গঠিত বিএনপি পায় ২০৭টি আসন। আর বিরোধী দল আওয়ামী লীগ পায় ৩৯টি।
জিয়া হত্যাকাণ্ডের ১০ মাস পর বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁর আমলে দুটি জাতীয় নির্বাচন হয়, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে।
ছিয়াশির নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩টি আসন, আওয়ামী লীগ ৭৬টি আর জামায়াতে ইসলামী ১০টি। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ২৯১টি আসন, আ স ম রবের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যরা এটি বর্জন করে।
আড়াই বছরের মাথায় এরশাদ গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনধারণাকে অসার প্রমাণ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে।
এরপর ১৯৯৪–১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হয়, যার শরিক ছিল জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও বাম–ডান প্রায় সব বিরোধী দল। বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে যে সংসদ গঠন করে, আন্দোলনের মুখে তা দেড় মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস করে ৩০ মার্চ সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
এরপর ১২ জুনের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি ও জাসদ রবের সহায়তায় ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ২৩০টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সরকার গঠন করে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে যেসব সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের ভারসাম্য ছিল, সেসব সংসদ অপেক্ষাকৃত কার্যকর ও প্রাণবন্ত ছিল। ক্ষমতাসীন দলকে জবাবদিহি করতে হতো। কিন্তু দুই–তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী ক্ষমতাসীন দল সেই জবাবদিহির তোয়াক্কা করেনি। আবার বিরোধী দলও সংসদের চেয়ে রাজপথে ফয়সালা করতে চেয়েছে, এখনো চাইছে।
বর্তমান সংকটের শুরু ২০০৪ সালে না ২০১১ সালে—এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিরন্তর বিতর্ক করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো দলই জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না।
এই প্রেক্ষাপটে কাল রোববার যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তার স্বরূপটি কী হবে? ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর আসছে, তাতে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, আগের কোনো মডেলে এই নির্বাচন হবে না।
নতুন মডেল তৈরি হবে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার মধ্যেও অভিনবত্ব আছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের দুই বা অধিক প্রার্থীর একজন নৌকা নিয়ে লড়ছেন। অন্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল, ট্রাক, কাঁচি ইত্যাদি নিয়ে।
এই নির্বাচন অতীতের কোনো নির্বাচনের মডেলে না হলেও দ্বিতীয় সংসদের কাছাকাছি যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। জিয়াউর রহমানের আমলের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রথম সারির প্রায় সব দলের সংসদ সদস্য ছিলেন। সেই সংসদে বিএনপির পাশাপাশি যেমন আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপের সদস্য ছিলেন; তেমনি ছিলেন সাম্যবাদী দল, মুসলিম লীগ, ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগের সদস্যও।
রাজনৈতিক মহলে তখন গল্প চালু ছিল যে জিয়া কুমিরের বাচ্চার মতো সব দল থেকে একজন–দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন।
এবারও মাঠের বাস্তবতা যা–ই থাকুক না কেন, জাতীয় পার্টি (জি এম কাদের), জাতীয় পার্টি (রওশন), কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, কল্যাণ পার্টি, বিএনএফ ইত্যাদি পার্টির নির্দিষ্ট প্রার্থী বা প্রার্থীদের নির্বাচিত করে আনার নানা তৎপরতা চলছে। বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়, ‘নৌকার প্রার্থীর বাইরে নির্দিষ্ট কিছু প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো কোনো মহল তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নামানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও চাপ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে অন্তত ১৫টি আসনে এমন তৎপরতার তথ্য পাওয়া গেছে।’
সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া নৌকাধারী প্রার্থীদের আরও ‘ত্যাগ’ স্বীকার করতে হবে। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকদের জন্য ৩২ জন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় এমনিতেই ভোটযুদ্ধটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে।
৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত এক–তৃতীয়াংশ আসনে দুই পক্ষের তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। এই প্রতিযোগিতায় যিনিই জয়ী হোন না কেন, জয় আওয়ামী লীগেরই থাকবে। কিন্তু অপ্রকাশ্যভাবে কিছু আসনে নৌকাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হলে সেটা আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত হবে।
অনেক দিক থেকেই এই নির্বাচন অভিনবত্বের দাবি করতে পারে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com