নির্বাচন শব্দটা শুনতে ভালোই লাগে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে নির্বাচন বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা কি হয়েছে? বিএনপির মতো বড় একটি রাজনৈতিক দল ও দলটির সমর্থক গোষ্ঠী নির্বাচনের বাইরে থেকে গেছে। ফলে এবারের নির্বাচনকে কোনো অর্থেই অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না।
একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে গেলে সব দলকে নির্বাচনে আসতে হবে এবং ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকতে হবে। এ দুটোর কোনোটাই এবারের নির্বাচনে দেখা গেল না।
আমি দুপুর ১২টা পর্যন্ত একটা সংবাদ চ্যানেলে ছিলাম। তখন পর্যন্ত যে খবর, তাতে বেশির ভাগ কেন্দ্রে ৫ শতাংশ, ১০ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতি দেখিনি। এ হিসাব অনুযায়ী, ম্যানিপুলেশন ছাড়া যদি ঠিকঠাকমতো ভোট গ্রহণ হয়, তাহলে সারা দিনে ২৪-২৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা নয়।
এরপরও আমরা দেখছি নির্বাচন কমিশন বলছে সারা দেশে ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। অথচ তাদের হিসাবেই বেলা তিনটা পর্যন্ত সারা দেশে ভোট পড়েছিল ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ক্ষমতাসীন দলের দিক থেকে চেষ্টা ছিল, ভোটার উপস্থিতি যাতে ৫০ শতাংশের মতো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ভোটার আনতে ক্ষমতাসীনেরা ব্যর্থ হয়েছে।
এবারের ভোট শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে বলে অনেকে বলছেন। ভোটের দিনে সহিংসতায় মুন্সিগঞ্জে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আরও কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত সহিংসতা হয়েছে।
আমাদের মতো ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় যদি শতাধিক মানুষ নিহত না হয়, তাহলে আমরা শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে বলেই ধরে নিই। কারণ, এখানে মানুষের জীবনের মূল্য খুবই কম। ভোটের আগের ও পরের সহিংসতায় হতাহতের খবরকেও আমরা খুব একটা বিবেচনায় নিই না।
ভোটের দিনে বিএনপি হরতাল ডেকেছে বলে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে, সেটা ভাবার কারণ নেই। বিএনপির যারা একেবারে একনিষ্ঠ সমর্থক, তাঁদের তো ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা নয়।
আওয়ামী লীগেরও একনিষ্ঠ সমর্থকগোষ্ঠী আছে। এর বাইরেও আমাদের দেশে বড় একটা সুইং ভোটার আছে। তাঁদের কোনো দলের প্রতি অঙ্গীকার নেই কিন্তু নির্বাচন নিয়ে তাঁদের আগ্রহ আছে।
জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে সুইং ভোটারদের একটা শক্ত ভূমিকা থাকে। এবারের ভোটে সুইং ভোটারদের সামনে যেহেতু প্রার্থী পছন্দের সুযোগ খুব সীমিত ছিল, সে কারণে তারাও অনেকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি।
এ কারণেই এবারের ভোটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজনের শেষ পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা। তবে তাঁদের সবাই ভোট দিতে গেছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর কারণ হলো, যদি মানুষ জেনে যায় যে ফলাফল পূর্বনির্ধারিত, তাহলে তারা মনে করে যে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার কোনো মানে নেই।
গণতন্ত্রের মানেই হলো অর্থপূর্ণ নির্বাচন। আমাদের দেশে পাঁচ বছর পরপর একটা নির্বাচন হতে হবে। একটা নির্বাচনে কত শতাংশ ভোটার ভোট দিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা সংবিধানে বলা নেই। কোনো নির্বাচনে ১ শতাংশ ভোটারও যদি ভোট দেন, তাহলেও আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য। সুতরাং, আইনগত দিক থেকে এবারের নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর এবারের নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হলো না। আমরা কার্যত দীর্ঘস্থায়ী একটা একদলীয় সরকারব্যবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্জন কিছুই হলো না। রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার খুব একটা আশা দেখছি না।
শুরু থেকেই দেখেছি নির্বাচন কমিশন অনেক ব্যাপারে নির্লিপ্ত থেকেছে। পরস্পরবিরোধী নানা কথাবার্তা বলে তারা সব সময় খবরের শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু মাঠের অনিয়মে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে ততটা আগ্রহী দেখা যায়নি। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো একজন প্রার্থীর টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি।
ভোটের দিনেও নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামে গুলির ঘটনা ঘটেছে। মুন্সিগঞ্জে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একজন মন্ত্রীর প্রকাশ্য ব্যালটে সিল মারা, আরেকজন মন্ত্রীর ছেলের জাল ভোট দেওয়ার ঘটনা আমরা দেখেছি। ওসির সঙ্গে হম্বিতম্বি করায় আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলেও এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সংখ্যা শেষ পর্যন্ত অতি নগণ্য।
তফসিল ঘোষণার পর থেকেই প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা পত্রপত্রিকায় দেখেছি। কিন্তু আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের বিপরীতে একটু সতর্ক করে দেওয়া, একটু ডেকে ব্যাখ্যা নেওয়ার এ ধরনের পদক্ষেপই আমরা দেখেছি। ফলে একজনের প্রার্থিতা বাতিল করা, এক-দুজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বা পোলিং এজেন্টের অব্যাহতি দেওয়ার মতো ঘটনা সংখ্যার দিক দিয়ে নগণ্য।
ভোটের আগের দিন ও ভোটের দিন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো হরতাল ডেকেছিল। আগের রাতে সিলেট, হবিগঞ্জসহ নানা জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। ফলে জনমনে একটা আশঙ্কা ছিল ভোটের দিন সহিংসতা হয় কি না।
বিচ্ছিন্ন দু-একটা ঘটনা ছাড়া বিএনপির সঙ্গে সহিংসতা হয়নি। এর একটা কারণ অবশ্য আমাদের প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়। প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী ও বিএনপির মধ্যে অনেক গোলমালই হতে পারত। এই গোলমাল না হওয়াটা একদিক থেকে ভালো। সহিংসতা হলে নিরীহ মানুষই হতাহত হয়।
বিএনপি এবারের নির্বাচন বর্জন করেছে, জনগণকে ভোট না দিয়ে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো নির্বাচন হলো। একই কাজ ২০১৪ সালে বিএনপি করেছিল।
নির্বাচন বর্জনের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি কী অর্জন করতে পারল, সেটা নিয়ে তাদেরকে অবশ্যই নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হবে।
বিএনপিকে তো জনগণকে জানাতে হবে নির্বাচন বর্জন করে তাদের কী কী অর্জন হলো। তাদের এটাও বুঝতে হবে যে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির অস্ত্র রাজনৈতিকভাবে ভোঁতা হয়ে গেছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর এবারের নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হলো না। আমরা কার্যত দীর্ঘস্থায়ী একটা একদলীয় সরকারব্যবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্জন কিছুই হলো না। রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার খুব একটা আশা দেখছি না।
সব দিক মিলিয়ে এবার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার একটা নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী আরেকবার আইনগতভাবে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা পেতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা নৈতিক বৈধতার সংকটে পড়ল।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক