নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টিও ইদানীং জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। সমকাল পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রকাশ্যে দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকার কথা বললেও তলেতলে আলোচনারও প্রস্তুতি চলছে। এবারে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন কয়েকটি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত। তাঁরা আলাদাভাবে দুই দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বলে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যতই অনড় অবস্থান দেখাক না কেন, নির্বাচনের আগে একটা সংলাপ হবে। তবে সেই সংলাপ সমস্যা সমাধানের জন্য নয়; এটা দেখানো যে তারা আলোচনার বিরোধী নয়।
গত তিন দশকে দেশি-বিদেশি উদ্যোগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে কয়টি সংলাপ হয়েছে, এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বিশিষ্ট পাঁচ বুদ্ধিজীবীর সংলাপ, ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানের উদ্যোগ দুই দলের সঙ্গে আলোচনা ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মধ্যকার বৈঠক এবং ২০১৩ সালে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উদ্যোগে দুই দলের সঙ্গে আলোচনা। এর কোনোটিই ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংলাপের চেয়ে রাজপথে সমাধানে বেশি উৎসাহী। দুই দলের নেতা-নেত্রীদের মনোভাবে সেটাই স্পষ্ট।
সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) সমন্বয়ে গঠিত এ দলের নেতৃত্ব দেন কার্ল এফ ইন্ডারফার্থ। ৮ থেকে ১১ অক্টোবর বাংলাদেশে অবস্থানকালে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতা, নির্বাচন কমিশন, নারীসমাজ, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন।
আইআরআই ও এনডিআই যথাক্রমে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত। এই দুটি দলের মধ্যেও প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হয়। বিরোধীপক্ষ প্রেসিডেন্টকে বিপদে ফেলে দেয়, এ রকম উদাহরণও কম নয়। কয়েক দিন আগেই জো বাইডেনের বাজেট আটকে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বাজেট আটকে গেলে কয়েক লাখ লোকের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে অনাস্থার হাত থেকে বাইডেন রেহাই পান। তারপরও দুই দলের যৌথ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছেন এখানকার নির্বাচন পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ দেখতে। বাংলাদেশে কী এটা ভাবা যায়! আগে বিদেশি আমন্ত্রণে দুই দলের সংসদ সদস্যরা একসঙ্গে যেতেন। এখন তো একসঙ্গে সংসদেও বসেন না। এক দফা আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির ৭ সংসদ সদস্যগত বছর ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন।
মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা শুনতে এসেছে। তাঁরা দেখতে ও বুঝতে চেষ্টা করেছেন, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশটি কতটা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হবে।
মার্কিন প্রতিনিধি দল এখানে কিছু না বললেও ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও অহিংস নির্বাচনের জন্য অগ্রগতির রোডম্যাপ হিসেবে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে। এই পাঁচ দফার মধ্যে আছে রাজনৈতিক নেতাদের সহনশীল বক্তব্য, নির্বাচনী ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফলপ্রসূ সংলাপ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা এবং ভিন্নমতকে সম্মান করা। একই সঙ্গে স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতি তৈরি করাসহ সব দলকে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। ১৪ অক্টোবর ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
যেদিন মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, সেদিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠেও সংলাপের কথা এল। রোববার সচিবালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি যদি শর্ত প্রত্যাহার করে, তাহলে সংলাপের বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। তবে শর্তযুক্ত সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। এর আগে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সরকারের পদত্যাগ চেয়ে বিএনপিই সংলাপের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার পদত্যাগের নীতিগত ঘোষণা দিলে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে; এর আগে নয়।
এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সংবিধান বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না। বাক্স্বাধীনতা, ভিন্নমতসহ সরকারের বিভিন্ন অবস্থান তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁরা যে কথাগুলো বলেছেন, এর প্রায় সব কটি মেনে নিয়েছি। সংবিধানের বাইরে বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না। সংবিধান ও আইন মেনে যদি কেউ নির্বাচনে আসে, তাহলে কিন্তু আলোচনারও প্রয়োজন থাকে না।’
নির্বাচন এলেই সরকারি দল সংবিধান ও জনগণের দোহাই দেয়। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির নেতারাও দিতেন। কিন্তু জনগণ কার পক্ষে আছে, সেটা যাচাই করার একমাত্র উপায় যে সুষ্ঠু, অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, সেটি তাঁরা মানতে চান না।
বিএনপির সরকার একই যুক্তিতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি করে ফেলেছিল। ২০০৭ সালেও তারা সেটি করে ফেলত, যদি না এক-এগারোর পালাবদল ঘটত। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও একই পদ্ধতিতে নির্বাচন করেছে। প্রথমটি বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল বর্জন করেছে। দ্বিতীয়টি সব দল অংশ নিলেও জনগণের গরিষ্ঠ অংশ ভোট দিতে পারেননি। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের যুবজরিপে দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। বয়স্কদেরও অনেকে বলেছেন, ২০০৮ সালেই তারা শেষ ভোট দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ সরকার আগামী নির্বাচনটি কীভাবে করবে? তারা কি একটি সুষ্ঠু ও অবাধ ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছে? যদি থাকে সংলাপে বসতে হবে। আর যদি না থাকে তাহলে ২০১৪ ও ২০১৮এর পুনরাবৃত্তি হবে। তাতে ক্ষমতা রক্ষা পেলেও গণতন্ত্র রক্ষা পাবে না।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বেশ জোর দিয়ে বলেন, বিএনপি এবারে নির্বাচন না করলে দলের অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না একতরফা নির্বাচন হলে ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির চেয়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি