এতটা কঠিন সময়ে বিএনপি কখনো পড়েনি

দলের বাইরে ও ভেতরে নানা দিক থেকেই বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে
ফাইল ছবি

প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছরের মাথায় এসে এক কঠিন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে বিএনপি। বিশেষ করে ২০২৩ সালের নির্বাচন বিএনপির আগামীর রাজনীতির জন্য রীতিমতো এক অগ্নিপরীক্ষা। খোলামেলাভাবে বললে এ নির্বাচনের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটাই যুক্ত। দল হিসেবে বিএনপি আদৌ কার্যকর থাকবে কি না, দেশের রাজনীতিতে বিএনপির কতটা প্রভাব থাকবে, তা এ নির্বাচনের ওপরই নির্ভর করছে। ১৯৭৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বিএনপি এতটা কঠিন সময়ের মুখে পড়েনি কখনো। বিএনপির মূল সংকট হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনো কোনো কাঠামোগত অবয়ব অর্জন করতে পারেনি। বিএনপি অনেকটা স্বেচ্ছাসেবীমূলক মনোভাব নিয়ে দল পরিচালনা করে। এ দলের সবাই নেতা। আবার কেউই নেতা নন। ইউনিয়ন পরিষদের কমিটি গঠন করতেও দলের শীর্ষ নেতারা হস্তক্ষেপ করেন। তাহলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাজই-বা কী?

প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বিএনপির বিকাশ ঘটেনি। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এক জেনারেল রাজনীতির পরিকল্পনা করলেন এবং বিএনপি নামে একটি দল গড়ে তুললেন। তিনি সফলও হলেন। যদিও সমালোচকদের দৃষ্টিতে সামরিক ছাউনিতে বিএনপির জন্ম। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পরপরই দলটি জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় এবং দ্রুতই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে বিএনপি এখন পরিণত বয়সে এসে উপনীত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি ভাঙনের মুখে পড়েছিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও আরেকবার ভাঙনের মুখে পড়ে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে দুবারই দলটি টিকে গেছে। এখনো রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? বিএনপি কি পারবে আবারও ক্ষমতার বৃত্তে ফিরতে নাকি রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে? ২০২৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি কীভাবে অংশ নেবে এবং এ নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার ওপর বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। দলের ভেতরে ও বাইরে নানা দিক থেকেই দলটি কঠিন সংকটের মুখে পড়ছে।

সম্প্রতি বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে মনে হবে, বিএনপি এই আছে, এই নেই। এই আছে ভাবটা কর্মীদের সক্রিয়তার প্রতিফলন। আর এই নেই ভাবটা নেতাদের দোনোমনা ভাবের ফলাফল। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপি সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছে। এই মিছিলগুলোতে জনসমাগম হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কোথাও কোথাও বিশাল সমাবেশ করেছে বিএনপি। পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিশাল সমাবেশ করেছে। নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ সমাবেশে যোগ দিয়েছে। হামলা-মামলা করেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঠেকানো যায়নি। বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে, গাড়িতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা হামলা করেছেন, ভাঙচুর করেছেন। সারা দেশেই তাঁদের ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু পরের দিনই আবার বিএনপির কর্মীরা মিছিল করেছেন। ১৪৪ ধারা জারি করায় বিএনপি বিকল্প স্থানে সমাবেশ করেছে। এত গুম, খুন, মামলা দিয়েও কর্মীদের দমিয়ে রাখা যায়নি।

ফলে বোঝাই যাচ্ছে, দল হিসেবে বিএনপিকে ভঙ্গুর ও দুর্বল মনে করা হলেও কর্মীরা যথেষ্ট সক্রিয় ও উদ্যমী। কিন্তু মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের এ গতিকে কেন্দ্রের নেতারা কতটা ধরে রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মাঠের কর্মীরা কর্মসূচি পালনে উদ্যমী হলেও কেন্দ্রের নেতারা মনে হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। নেতারা কর্মীদের সঙ্গে ঠিকমতো তাল মেলাতে পারছেন না। একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে কর্মসূচিও প্রণয়ন করতে পারছেন না। যেমন ভোলায় বিএনপির দুই কর্মী নিহত হওয়ার পর হরতাল দিয়েছিল। কিন্তু আধা বেলা হরতালের পরই তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কর্মসূচি ঘোষণার আগেই ভালো করে চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। কর্মসূচি দিয়ে ধরে রাখতে না পারা একধরনের ব্যর্থতাই। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই অর্ধদিবস হরতাল দিলে সমীচীন হতো। ঢাকায় বিশাল সমাবেশের পর অনেকেই ঠাট্টা করে বলেছেন, বিএনপির নেতারা যদি জানতেন সমাবেশে এত মানুষের সমাগম হবে, তবে সকালে কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে সমাবেশ বাতিল করে দিতেন বা সংক্ষিপ্ত করে ফেলতেন সমাবেশ।
বিএনপির সংকট জনসমর্থনে বা কর্মীদের উদ্যম নিয়ে নয়, বরং বিএনপির সংকট নেতৃত্বের জায়গায়। নেতাদের মধ্যে মনে হয় কর্মসূচি নিয়ে একধরনের অনীহা কাজ করে। কর্মসূচি মানেই রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও নয়; নানা ধরনের কর্মসূচি হতে পারে। রাজপথের পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মসূচির আয়োজন করতে পারে বিএনপি।

দলের বাইরে ও ভেতরে নানা দিক থেকেই বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব সমস্যা কাটিয়েই বিএনপিকে সামনে আগাতে হবে এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ নির্বাচনে কোনোভাবে পা হড়কালে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে গেলে বিএনপি আবারও হাসির পাত্রে পরিণত হবে। অথবা বিএনপি নির্বাচনে গেল না, কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করে ফেলল। এ ক্ষেত্রেও বিএনপি বিপাকে পড়বে।

বিএনপি প্রায়ই অভিযোগ করে, গণমাধ্যমে তাদের কর্মসূচি সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। এ ক্ষেত্রে বিএনপি বিকল্প নিজস্ব গণমাধ্যম সৃষ্টি করতে পারে। আজকাল রাজনৈতিক দলগুলো গণমাধ্যমে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে। আওয়ামী লীগ গণমাধ্যমকে লালন-পালন ও বিনিয়োগের সুফল ভোগ করছে। বিএনপিকেও গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করতে হবে। বিএনপিই দেশের একমাত্র দল, যাদের কোনো গণমাধ্যম নেই। তাদের কোনো সুশীল সমাজও নেই। বিএনপি বলতে পারে, সরকার তাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেবে না। তাহলে বিকল্প পন্থা বের করতে হবে। রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করাই রাজনীতির মূল লক্ষ্য।
মোদ্দাকথা, রাজনীতির মাঠের লড়াইয়ের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লড়াইয়েও সক্রিয় হতে হবে। সাংস্কৃতিক মাঠে সক্রিয় হতে হবে। বিএনপির রাজনীতির নিজস্ব বয়ান বর্তমানের আলোকে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। হামলা-মামলার এ সময়ে বিকল্প রাজনীতির ভাবনা বিএনপির কাজকর্মে তেমন প্রতিফলিত হচ্ছে না। সম্ভবত বিএনপির নেতারা রাজনীতি বলতে কেবল রাজপথে মিছিল-সমাবেশকেই বুঝে থাকেন। আর হতে পরে দীর্ঘ সময় ধরে চলা হামলা, মামলা, নির্যাতন, গুম, খুনের কারণে তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যে কারণে কোনো ধরনের কর্মসূচি দিতে ও পালন করতে সংকোচ বোধ করেন। নতুন করে আর ঝামেলা সংকটে পড়তে চান না।

অথবা নেতাদের কেউ কেউ ভিন্ন দল বা দেশের হয়ে বিএনপির ভেতর থেকেই খেলছেন। কারণ, বিএনপির অনেকের বিরুদ্ধেই সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ করেন দলটির কর্মীরা। মাঠের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, এ অংশ সরকারের হয়েই বিএনপির নামে খেলছেন। তাঁদের নতুন মিশন হচ্ছে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে নিয়ে আসা। বাজারে ১০০ আসনের একটি কথা প্রচলিত আছে এখন। বলাবলি হচ্ছে, বিএনপি আওয়ামী লীগের অধীনই ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনে গেলে নির্বাচনে ১০০ আসনে জয় পাবে এবং খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হবে। এ ফাঁদে ফেলে বিএনপিকে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে বিরত রাখা বা ফিরিয়ে আনাই এ অংশের কাজ বলে অভিযোগ করছেন অনেক কর্মী। বিনিময়ে তাঁরা নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করার নিশ্চয়তা পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, দলের বাইরে ও ভেতরে নানা দিক থেকেই বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব সমস্যা কাটিয়েই বিএনপিকে সামনে আগাতে হবে এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ নির্বাচনে কোনোভাবে পা হড়কালে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে গেলে বিএনপি আবারও হাসির পাত্রে পরিণত হবে। অথবা বিএনপি নির্বাচনে গেল না, কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করে ফেলল। এ ক্ষেত্রেও বিএনপি বিপাকে পড়বে। কারণ, দেশের অনেকেই এই গুমোট রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন চান। আরও চান এই পরিবর্তনে বড় দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্ব দিক। কিন্তু বিএনপির অনেকেরই অনুযোগ হচ্ছে, দেশের মানুষ মাঠে নামে না কেন। এর জবাব হচ্ছে, দেশের জনসাধারণ তো পথে নেমে বিএনপির হাতে নেতৃত্ব তুলে দেবে না। বড় দল হিসেবে বিএনপিকেই বরং জনসাধারণকে নেতৃত্ব দিতে হবে। যদি সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে না পারে, তবে বিএনপির নেতৃত্বের গুণাগুণ প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধা নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দেবে। বিএনপির থেকে জনসাধারণ মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। মনে রাখতে হবে, স্থান কখনো শূন্য থাকে না। নতুন কেউ জনগণকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবে। দেশের মানুষ তো আর অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারে না।

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক