ভারত ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছে, যা দেশটির ভোটারদের পরিপক্ব করেছে
ভারত ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছে, যা দেশটির ভোটারদের পরিপক্ব করেছে

যেসব কারণে মোদির জনপ্রিয়তা ধাক্কা খেল

বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমরা অচ্ছুত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ম্যান্ডেটকে পাকিস্তানি সেনাশাসকেরা উপেক্ষা করায় আমরা স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু করি। অর্জন করি বিজয়। বিজয়ের পর সংবিধানের প্রণেতারা অত্যন্ত সদিচ্ছা নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত গড়ে তোলেন। 

শুরু হয় প্রত্যাশিত ব্যবস্থা। কিন্তু একের পর এক ধাক্কা সে পথচলাকে কার্যত নির্দেশনাহীন করে ফেলে। অজেয় জাতি আবার পথ খুঁজে নেয় ১৯৯১ সালে। কিন্তু সৌভাগ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আবারও মুখ থুবড়ে পড়েছে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তবে আমরা এ বিষয়ে সবাই অতি উৎসাহী। তাই উৎসাহ নিয়ে লক্ষ করি কিছু কিছু দেশের নির্বাচন। প্রতিবেশী ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচন কার্যক্রমগুলো এবং এর ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করতে থাকি। অতি সম্প্রতি আমরা দেখলাম ভারতের দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচন। ফলাফলও জানলাম। 

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি এর ছন্দপতন ঘটায়। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সবল নেতৃত্ব ও কুশলী রাজনীতিক ভারতরত্ন ইন্দিরা গান্ধী। এত সব সত্ত্বেও জরুরি অবস্থা জারি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কালাকানুন ভারতের জনগণ মেনে নেয়নি। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল পরাজিত হয়। ভারতীয় জনগণ সফল হয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে। 

তবে ১৯৮০ সালে সেই ইন্দিরা গান্ধী আবার বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং তাঁর আগের সরকারের সময়ের বাড়াবাড়ির জন্য ভারতীয় ভোটারদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আবারও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তিনি গঠন করেন সরকার। আমৃত্যু বহাল ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদে। সে দুটি নির্বাচন ভারতের ভোটারদের গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন বলে বিবেচনা করা হয়। 

এবারের নির্বাচনের আগে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার। এর আগে মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। সেখানকার একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি বিতর্কিত হলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষতার ছাপ রাখেন।

ভারতবাসী ২০১৪ সালে তাঁর মধ্যে একজন যোগ্য ও দক্ষ নেতার ছাপ দেখতে পেয়ে নির্বাচিত করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এর পরবর্তী ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তিনি সে বিজয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। এই ১০ বছর শাসনকালে তিনি ভারতের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বৃদ্ধি পেয়েছে জিডিপি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সবল করেছেন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। 

দীর্ঘদিনের বিজেপির ভোট প্রাপ্তির হাতিয়ার রামমন্দির যে স্থান থেকে নির্মিত হয়েছে, সেই অযোধ্যায় হেরে গেল তারা। ফলাফলে জোটের সমীকরণ অনেকটা কাজ করেছে, এটা অসত্য নয়। তবে এ ধরনের সমীকরণ আগেও ছিল। অনেক জাতপাত, ধর্ম, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ে বিভক্ত ভারতকে জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর পর নরেন্দ্র মোদি দৃঢ়তার সঙ্গে সামনের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু কমে গেল জনসমর্থন। এর কারণ অনেক।

তবে অভিযোগ রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, আয়বৈষম্য ও ধনিকশ্রেণির সপক্ষে বিভিন্ন আইন প্রণয়নের। আরও অভিযোগ আছে—ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব দমনে ব্যর্থতা।

দরিদ্র ও সমাজের অবহেলিত অংশের প্রতি রাজ্য সরকারগুলোর বিভিন্ন কল্যাণকর কর্মসূচিতে যথাযথ সহযোগিতা না করার অভিযোগও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে। সম্ভবত নির্বাচনী ফলাফলে ঘটেছে এর প্রতিফলন।

ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও সরকার গঠন করতে আবশ্যক হবে শরিক দলের সহায়তা। এ ক্ষেত্রে বিহারের নীতীশ কুমার ও অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর যথেষ্ট প্রভাব থাকবে সরকারে। উল্লেখ্য, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের শক্তি কিছুটা কম হলেও একেবারে ফেলনা নয়। 

প্রশ্ন আসে, এবার নরেন্দ্র মোদির দল ২০১৯ সালের নির্বাচন থেকে ৬০টির কম আসন কেন পেল? কেন সংখ্যালঘিষ্ঠ হলো উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলোয়। দক্ষিণের রাজ্যগুলোয় আগে থেকেই তাদের তেমন কোনো অবস্থান ছিল না। এবার বরং সামান্য উন্নতি করেছে। কংগ্রেস আগের অবস্থান থেকে এগিয়েছে অনেক। চমকপ্রদ ফল করেছে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দল। 

দীর্ঘদিনের বিজেপির ভোট প্রাপ্তির হাতিয়ার রামমন্দির যে স্থান থেকে নির্মিত হয়েছে, সেই অযোধ্যায় হেরে গেল তারা। ফলাফলে জোটের সমীকরণ অনেকটা কাজ করেছে, এটা অসত্য নয়। তবে এ ধরনের সমীকরণ আগেও ছিল।

অনেক জাতপাত, ধর্ম, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ে বিভক্ত ভারতকে জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর পর নরেন্দ্র মোদি দৃঢ়তার সঙ্গে সামনের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু কমে গেল জনসমর্থন। এর কারণ অনেক।

প্রথমেই বলতে হয় ধনী-দরিদ্র পার্থক্য ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। বেড়েছে বেকারত্ব। বিজেপি সংবিধান পরিবর্তন করে ভারতের রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য পাল্টাতে পারে—এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

জওহরলাল নেহরু কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর মডেলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে অথবা অনুকরণ করার মতো নয়। তবে অনগ্রসর শ্রেণিগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন কল্যাণমুখী কার্যক্রম আয়বৈষম্য কমাতে অনেকটাই সহায়ক হতে পারে—এ বিষয়ে বিজেপি জাতীয় পর্যায়ে তেমনটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল না। পক্ষান্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই এটাকে প্রধান পুঁজি করেছিল। এর সুফলও তারা পেয়েছে।

কৃষি আবহমানকাল থেকে ভারতের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। সে খাতের চালিকা শক্তি কৃষকেরা নরেন্দ্র মোদির সরকারের কাছে অনেকটাই উপেক্ষিত ছিলেন বলে অভিযোগ বারবার হয়েছে। সেই বিক্ষুব্ধ কৃষকসমাজ ধর্মীয় উন্মাদনার ঊর্ধ্বে থেকে ভোট দিয়েছেন—এমনটাই দেখা যায়। বিশেষ কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জিগির তুলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল মেলে না, এটাও এই নির্বাচনের একটি শিক্ষা। 

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বললেও অনেকটা বিপরীত চিত্রই দেখা গেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। তবে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ভারতের সরকার ও জনগণের অবদানকে আমরা কৃতজ্ঞার সঙ্গে স্মরণ করি। তেমনই প্রশংসা করি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, পাহাড়ি সশস্ত্র জনগোষ্ঠীকে ফেরত পাঠানো, ছিটমহল বণ্টনের প্রশ্নে ভারতীয় শাসকদের উদারতার। 

অন্যদিকে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনে অনীহা, ট্রানজিটসহ বিভিন্ন ব্যবস্থায় অসম চুক্তি, সীমান্তে অব্যাহত হত্যাকাণ্ড আমাদের আহত হওয়ার কারণ। তা ছাড়া বাংলাদেশের সরকার গত দেড় দশক একটি অংশগ্রহণমূলক পক্ষপাতহীন নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনেও ভারত সরকারের কূটনৈতিক সমর্থন রয়েছে—এমন ধারণাও ব্যাপক। সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সদ্ভাব থাকলেও এ দেশের জনগণ ভারতের বর্তমান শাসকদের সদিচ্ছা সম্পর্কে সংশয়বাদী। ঠিক তেমনই অবস্থা শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের। ইতিমধ্যে ছোট রাষ্ট্র মালদ্বীপে ভারতবিরোধী মনোভাবের বিস্ফোরণ ঘটেছে।

আমরা প্রয়োজনে ভারতকে সব সহযোগিতা দিতে চাই। তাদের সাতটি পাহাড়ি রাজ্যে সহিংস তৎপরতা দমনে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে সে প্রমাণ বাংলাদেশ রেখেছে। আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে উদীয়মান ভারত তার প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জনে সফল হচ্ছে না। এটা অনেকটাই অনুভূত হয়েছে মোদি সরকারের সময়ে। ভারতের সচেতন ভোটাররা নিশ্চয় এ বিষয়ও নজরে রেখেছেন। 

এবার থাকছে দেশটির উদার গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির প্রসঙ্গ। এবারের নির্বাচনকালে একজন মুখ্যমন্ত্রী ও একজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তারের বিষয়টি ভারতের জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণে ইডি, সিবিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে—এমনও অভিযোগ রয়েছে। এর সব ছাপই পড়েছে আলোচিত নির্বাচনে এমনটা অনুমান অসংগত হবে না।

উদার গণতন্ত্রের স্বাদ পাওয়া ভারতের ভোটাররা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করেননি। গণতন্ত্রের চর্চা যেখানে আছে, সেখানে এমনটি দেখা যায়। এ দেশেও তা-ই দেখা গেছে স্বাধীনতার আগে ও পরে। যখন জনগণ সুযোগ পেয়েছে, সে সুযোগ তারা ব্যবহার করেছে সঠিকভাবে। 

ভারত ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করছে। এর বিপরীতে যখন যে শক্তি এসেছে, তাকে সুযোগমতো বার্তা দিয়েছে। এবারও তারা সে বার্তা দিল ইভিএমে বোতাম টিপে। এ প্রসঙ্গে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকের সংবাদভাষ্যের শিরোনাম ‘পরাজয়ের অনুভূতিসম্পন্ন একটি জয়’। আর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের নির্বাচনী ফলাফলকে নিবন্ধে বলা হয়েছে ‘বিজয়ের সাদৃশ্য একটি পরাজয়’। সত্যিকার অর্থে ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে এমনটাই ঘটল। 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

majumderali1950@gmail.com