ট্যুং! একটা নোটিফিকেশন! লাইক, শেয়ার নাকি কমেন্ট? দৌড়ে গিয়ে মুঠোফোনটা হাতে নেয় সাদিয়া (ছদ্মনাম)। ফেসবুক চেক করে দ্রুত। মুখে হাসি। ২১ টা লাইক পড়েছে ছবিতে। মন্দ না। দ্রুত ঘুরে আসে লাইকের তালিকা থেকে। মন একটু খারাপও হয়। সবচেয়ে কাছের বন্ধু যাকে মনে করে, তার কোনো খবরই নেই। সে কি দেখেনি ছবিটা? নাকি দেখেও কিছু বলল না! চোখের পলকে মুহূর্তের জন্য মনের কোণে উঁকি দেয়, ‘হুহ! নিশ্চিত হিংসা’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধব মিলে প্রায় ৮/১০ জনের বড় একটা দল গেছে রেস্তোরাঁয় খেতে। খাবার আসতে না আসতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে ছবি তুলতে। চেকইন দিতে হবে, সঙ্গে দিতে হবে সুস্বাদু সব খাবারের ছবি। পরিচিত, আত্মীয়, বন্ধুসহ ফেসবুকের তালিকায় যে যে আছে, সবাইকে জানাতে হবে কোথায় খেতে গেলাম, কী খেলাম, কতটা আনন্দ করলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর শুরু হলো পোস্ট করা ছবিতে লাইক, কমেন্ট গোনার পালা। সময় কই নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার? তারপরও কথা যে একেবারে হয় না, তা নয়, কিন্তু বেশির ভাগই মুখ গুঁজে আছে মুঠোফোনের পর্দায়। বিশেষ করে মেয়েরা ব্যস্ত কোন ছবিতে কেমন লাগছে দেখতে, কয়টা লাইক পড়ল, কে কী মন্তব্য করল সেই আলোচনায়।
আনিকা, সাদমানের গভীর প্রেম। কদিন পরই বিয়ে করবেন তাঁরা। খেতে গেছেন নামীদামি এক রেস্তোরাঁয়। সুন্দর করে সেজেছে আনিকা, চমৎকার মানিয়েছে দুজনকে। আনিকা–সাদমান দুজনই ব্যস্ত। না, পরস্পর কথা বলায় কিংবা নিজেদের আরও ভালোভাবে জানায় নয়। আনিকা ব্যস্ত নিজের সবচেয়ে সুন্দর পোজটি খুঁজে বের করায় আর সাদমান সেই ছবি তোলায়। পরস্পরকে সময় দেওয়ার সময় কোথায় তাদের?
রায়হান সাহেব পরিবার নিয়ে প্রথমবারের মতো বেড়াতে গেছেন কক্সবাজারে। একটা নতুন জায়গায় বেড়ানো, শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে গিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দময় কিছু সময় কাটানো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা, আরাম করা—এই ছিল উদ্দেশ্য। তিনি চেয়েছিলেন, পরিবারের বাকি সদস্যরাও শহুরে জীবনের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে একটু দম নিয়ে নিক। কিন্তু সেটা কি আর হয়? বিচে থেকে সূর্যাস্ত দেখা, এটিভিতে চড়া, সমুদ্রে নামা, স্পিডবোটে চড়া, রেস্টুরেন্টে ও রাস্তার পাশে সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউর দোকানে খাওয়া, ‘বার্মিজ মার্কেটে’ শপিং—এমন আরও কত ছবি তোলার উপলক্ষ সেখানে। তাই পুরোটা সময় পরিবারের সবাই ব্যস্ত ছবি তুলতে। আর কেবল তো ছবি তোলা নয়, সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া, মানুষের রিঅ্যাকশন খেয়াল রাখা, দিনে এক–দুই বার লাইভ করা, কাজ তো কম নয়। এই করেই মুহূর্তে কেটে গেল ছুটির দুই–তিনটা দিন।
নওরিনের বিয়ে। কনের বসার জায়গার আশপাশে রীতিমতো সিনেমা শুটিংয়ের লাইটিং। সামনে ক্যামেরার জন্য ট্র্যাক বসানো হয়েছে। একজন নির্দেশকের নির্দেশনামতো চলছে সবকিছু। কনের কাছে কারা, কখন, কীভাবে যাবেন, আদৌ যাবেন কি না, সবকিছু চলছে নির্দেশনামতো। আছে স্টিল ফটোগ্রাফারও। এই তীব্র আলোয় অনভ্যস্ত নওরিন, তার চোখ খোলা রাখতেই কষ্ট হয়, তার মাথা ধরে যায়, কিন্তু সে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে, যেন তার প্রতিটি পোজ মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বিয়ে, না সিনেমার শ্যুটিং বোঝার উপায় নেই। যে করেই হোক, মানুষকে চমকে দিতে হবে। মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারা মানেই অনলাইনে হিট, ফেসবুকে ভাইরাল।
পাঁচটি ঘটনাই অতি সাধারণ, আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করি, তাদের খুবই পরিচিত। এবার আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলি, যেটি আমার ১০ বছরের ফেসবুকজীবনে মাত্র একবারই ঘটেছিল। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র সন্তান লাইভ করেছিলেন। মৃতদেহ লাশবাহী গাড়িতে তোলা, সেই গাড়ি এলাকায় যাওয়া থেকে শুরু করে কবরে লাশ নামানো পর্যন্ত পুরোটা লাইভ দেখলাম আমরা। আমি নিজেও একমাত্র সন্তান এবং বাবা হারানোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি বলেই জানি, বিষয়টি কতটা অসুস্থ এবং অস্বাভাবিক।
এ ছাড়া ফেসবুকে নিজের প্রফাইলকে জায়নামাজ বানিয়ে সেখানে নিয়মিত বিরতিতে মোনাজাত করা, বাড়িতে মা–বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ মাহফিল ফেসবুক লাইভে প্রচার করা—এসব তো আছেই। যা হওয়ার কথা ছিল একান্ত নিজস্ব, যে মিনতি স্রষ্টার দরবারে একান্তে করার কথা ছিল, সেটি এখন ফেসবুকের কল্যাণে সবার জন্য উন্মুক্ত। আমার একজন অতি পরিচিতা গত ২১ বছর একা তাঁর অসুস্থ মা–বাবার সেবা করেছেন। বাবা চলে যাওয়ার পর শয্যাশায়ী মাকে নিয়ে এখনো তাঁর দিন কাটে। অতি অল্প বয়সে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ায় নিজের ব্যক্তিজীবনে অপূর্ণতা আছে অনেকটুকুই। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো দিন তাঁকে দেখিনি, বাবা কিংবা মা দিবসে বিশ্বকে জানান দিয়ে ছবিসহ ফেসবুকীয় আবেগে ভাসতে। যেকোনো সম্পর্কের অন্তঃসারশুন্যতা বোধ করি আড়ম্বর দিয়েই পোষাতে হয়।
ফেসবুকে প্রতিটি স্ট্যাটাস আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের অবচেতনে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়, সেই স্ট্যাটাসের কতটা রিঅ্যাকশন হতে পারে। সেটা ছাড়িয়ে গেলে তো বটেই, কাছাকাছি মাত্রায় পূরণ হলেও হলে আমরা পাই আমাদের প্রত্যাশিত মাত্রার ডোপামিন। আর রিঅ্যাকশনের মাত্রা প্রত্যাশার চেয়ে কম হলে, প্রত্যাশিত মাত্রার ডোপামিন না পেলে, মানুষ অস্থির হয়, অশান্তি তৈরি হয় মনে
ফেসবুকে আসক্ত হওয়াই কি নিয়তি?
আচ্ছা বলুন তো, কখনো কি ভেবেছেন, কেন এত আসক্ত আমরা ফেসবুকে? কেন শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু পরপরই তীব্র ইচ্ছা করে ফেসবুক থেকে একটু ঘুরে আসতে? ইচ্ছা করে দেখতে কে কে দেখল আমার স্ট্যাটাস, আমার ছবি, লাইক পড়ল কয়টা, কমেন্ট করল কে, এমনকি কে কোন ধরনের রিঅ্যাকশন দিল! ফেসবুক নিয়ে আমাদের মাতামাতির পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।
ফেসবুক মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। এই সিস্টেমে কোনো বস্তু গ্রহণ কিংবা কাজ করা মস্তিষ্কে এক ধরনের রাসায়নিক (নিউরোট্রান্সমিটার) ‘ডোপামিন’–এর নিঃসরণ বাড়ায়। ডোপামিন মানুষকে ক্ষণিকের আনন্দ-উত্তেজনার অনুভূতি দেয়। কিন্তু কিছু সময় পরই ডোপামিনের মাত্রা কমে যায়। তখন মানুষ আবারও সেই বস্তু গ্রহণ করতে কিংবা সেই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়, যাতে সে তার আনন্দের উৎস ডোপামিন পায়। এই চক্র ক্রমাগত চলতেই থাকে। কিন্তু একটা সময় যে পরিমাণ ডোপামিনের কারণে আনন্দ–উত্তেজনার অনুভূতি পাওয়া যেত, সেই পরিমাণ দিয়ে আর সেটা পাওয়া যায় না। ফলে পরিমাণ বাড়াতে হয়। বাড়াতে হয় নিঃসরণের ফ্রিকোয়েন্সি। ফেসবুকের ক্ষেত্রে যা ঘটে, ঠিক এটাই ঘটে আর সব উত্তেজক নেশার বস্তু গ্রহণ করার পর। ব্রেইন স্ক্যান করে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন ফেসবুক আসক্তি আর কোকেনের মতো উত্তেজক মাদকের আসক্তির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে একই ধরনের পরিবর্তন হয়। বিষয়টির ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন?
ফেসবুকে থাকা হবে আর সেটার প্রতি মৃদু, মাঝারি কিংবা তীব্র আসক্তি হবে না, এটা হতে পারে না। জুয়ার জন্য বিশ্বখ্যাত শহর লাস ভেগাসের ক্যাসিনোগুলোর ভবনের ডিজাইন, জুয়া খেলার ঘরের আসবাব, আলোকসজ্জা, মিউজিক সবকিছুর পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়, যেন সেটা মানুষকে তীব্রভাবে জুয়া খেলতে প্রলুব্ধ করে।
ক্যাসিনোর গেমগুলোও এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়, যেগুলো একবার খেলতে ঢুকলে তাতে খুব দ্রুত আসক্তি তৈরি হবে, মানুষ খেলতে থাকবে এবং খেলতেই থাকবে। যেসব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান মানুষ লাস ভেগাসের ক্যাসিনোর নেশা তৈরির পেছনে কাজ করেন, তাদের মতো পৃথিবীর অতি প্রতিভাবান মনোবিজ্ঞানী, বিপণনকারীরা ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছেন কীভাবে ফেসবুকের অ্যালগরিদমকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, যাতে সেটা মানুষকে আসক্ত করে তোলে। লাস ভেগাস তাও ‘ভালো’– জুয়া খেলতে হলে সেখানেই যেতে হয়। এর ব্যাপ্তি কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত হয় সর্বোচ্চ। কিন্তু ফেসবুক পরিণত হয়েছে এক সর্বকালীন জুয়ার স্লট মেশিনে, যে মেশিন ঘুমানোর আগ পর্যন্ত হাতে রাখা যায় আর সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে চলে আসে।
আসক্তি একজন মানুষের জীবনে তীব্র অশান্তি তৈরি করে। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রার ডোপামিন যদি কেউ না পায়, তাহলে সেটা তাকে অস্থির করে তোলে। ফেসবুকে প্রতিটি স্ট্যাটাস আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের অবচেতনে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়, সেই স্ট্যাটাসের কতটা রিঅ্যাকশন হতে পারে। সেটা ছাড়িয়ে গেলে তো বটেই, কাছাকাছি মাত্রায় পূরণ হলেও হলে আমরা পাই আমাদের প্রত্যাশিত মাত্রার ডোপামিন। আর রিঅ্যাকশনের মাত্রা প্রত্যাশার চেয়ে কম হলে, প্রত্যাশিত মাত্রার ডোপামিন না পেলে, মানুষ অস্থির হয়, অশান্তি তৈরি হয় মনে।
এ তো গেল নিজের সঙ্গে নিজের তুলনা, ফেসবুক মানুষকে ক্রমাগত অপরের সঙ্গে তুলনায় মগ্ন রাখে। ফেসবুকে পরিচিত, এমনকি অপরিচিত ‘ফেসবুক বন্ধু’দের জীবনের নানা সুন্দর দিক দেখতে দেখতে আমরা ভুলে যাই ফেসবুক মানুষের মুখ নয়, ওটা আদতে মুখোশ। মানুষ তার সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর সবচেয়ে সফল চিত্রটিই ফেসবুকে প্রকাশ করে। অন্যদিকে মানুষ অপরের মুখোশকে নিজের মুখের সঙ্গে তুলনা করে ঈর্ষান্বিত হয়। আবার এই মাটির সন্তান বলে আমাদের অনেককে পেয়ে বসে নিতান্তই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ‘পরশ্রীকাতরতা’।
ফেসবুক বন্ধুদের নানা কর্মকাণ্ড তো আছেই, সঙ্গে নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আমাদের সামনে নিয়ে আসে নানা পণ্যের পসরা। আমাদের মধ্যে জাগ্রত করে লোভ, ভোগবাদী জীবনযাপনের তীব্র বাসনা। এককথায় ফেসবুক প্রতিটি মুহূর্তে উসকে দিতে থাকে আমাদের জন্মগত জিনগত বৈশিষ্ট্য বা ‘ইড’ কে। ‘ইড’কে ক্রমাগত উসকে দিয়ে দুর্দান্ত ব্যবসা হতে পারে, কিন্তু সেটা মানুষকে ভয়ংকরভাবে স্ট্রেসড, আক্রমণাত্মক এবং সর্বোপরি অসুখী করে তোলে। তাই ফেসবুকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মানুষকে করে স্ট্রেসড, বিষণ্ন, উদ্বিগ্ন, উসকে দেয় ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, তৈরি করে হীনম্মন্যতাবোধ, জাগায় ঘৃণা। মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেকে তুলনা করে অন্যের সঙ্গে। এবং নিজের কী আছে তা নয়, বরং কী নেই তা নিয়ে অস্থিরতায় ভুগতে থাকে।
প্রত্যেক মানুষ নিজেকে ভালোবাসে, বাসাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু মানুষ এতই আত্মপ্রেমিক (নার্সিসিস্ট) হয়ে ওঠেন যেটা একটা ত্রুটিপূর্ণ ক্ষতিকর ব্যক্তিত্বের ধরন ‘নার্সিসিস্টিক পার্সোন্যালিটি ডিজঅর্ডার’ তৈরি করে। ব্যক্তিত্বের এই ধরনের বিকৃতির শিকার মানুষেরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পোষণ করেন, নিজেদের অন্যদের তুলনায় মূল্যবান এবং শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এই মানুষদের জীবন সংকটে পরিপূর্ণ হয়। এরা চান আর সবাই তাঁদের শুধু শ্রদ্ধাই নয়, ভক্তি করবে, তাঁদের সবকিছু মেনে নেবে। এর অন্যথা হলেই তাঁরা অসুখী হয়ে ওঠেন।
নার্সিসিস্টিক পার্সোন্যালিটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত মানুষদের ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের মানুষদের মধ্যেও। প্রচণ্ড দম্ভে ভোগা এসব মানুষ প্রায় সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। নিজের কোনো ধরনের অর্জনের জন্য তাঁরা যে কারও ক্ষতি করতে দ্বিধা করেন না। সর্বোপরি অন্য মানুষদের আবেগ এরা বোঝার চেষ্টা করেন না, সেটা অনুভব করেন না (এম্প্যাথির চরম অভাব ঘটে)। ফলে তাঁদের আশপাশের মানুষ তাঁদের কোনো সমস্যা, সংকটে এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মানুষদের কাছ থেকে উপকার পাওয়া দূরেই থাকুক, সহানুভূতিও পান না। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত বেশি সময় কেউ কাটান, তাঁর এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব ‘নার্সিসিস্টিক পার্সোন্যালিটি ডিসঅর্ডার’ তৈরির সম্ভাবনা অনেক বেশি বাড়ে।
শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, আমাদের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনেও আছে ফেসবুকের ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব। ফেসবুকের সিভিক ইন্টিগ্রিটি ডিপার্টমেন্টের সাবেক প্রডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হাউগেন বিশ্ব তোলপাড় করা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ফেসবুকের অ্যালগরিদম রিচ এবং এনগেজমেন্ট বাড়ানোর জন্য ফেসবুক ঘৃণা-বিদ্বেষ-সহিংসতাপূর্ণ খবর, ফেক নিউজ বেশি বেশি ছড়িয়ে দেয়, যা তার আয় বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। এসব বিষয় সমাজে অসন্তোষ, অস্থিরতা বাড়িয়ে দিলেও ফেসবুক সেগুলো প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। এ ছাড়া অনুমতি ছাড়া মানুষের ব্যক্তিগত ডেটা নিয়ে সেটাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা ছড়ানো কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা কেলেঙ্কারির (ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ব্রেক্সিট নির্বাচনে প্রভাব রাখা) কথা আমাদের স্মৃতিতে তাজা থাকার কথা। আজ এটা গৃহীত মতামত, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণতন্ত্রের জন্য ভয়ংকর হুমকি তৈরি করেছে। এটাও এক খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, যা আজকের এই কলামের কলেবরে আর সম্ভব নয়, করা যাবে আরেক দিন।
তাহলে কি ফেসবুক ব্যবহার করব না আমরা? নিশ্চয়ই করব। কিন্তু সেই সঙ্গে মাথায় রাখব, ফেসবুকে অতি আসক্তি ঠিক কী ক্ষতি করতে পারে আমাদের। যে বিনোদন কোকেনের নেশার আনন্দ কিংবা লাস ভেগাসের জুয়ার আসক্তি মস্তিষ্কে তৈরি করে, তাকে খুব সহজভাবে নেওয়া ঠিক হবে না।
রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী